অনলাইন শিক্ষার দ্বিত্ব রূপ

 অনলাইন শিক্ষার দ্বিত্ব রূপ

গত মার্চ মাস থেকে করোনা নামক মারাত্মক ভাইরাসের কারণে দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে দুঃচিন্তায় কাটাচ্ছিল দিন। কি হবে তাদের শিক্ষা জীবনের? কতদিন থাকবে এই ভাইরাস! অনেকেই ভেবেছিলো হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কয়েক মাসেই! কিন্তু ধীরে ধীরে বছরও শেষ হতে চলেছে! দীর্ঘদিনেও হয়নি কোন সুরাহা! বরং বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকগণ পাশ্চাত্য দেশকে ফলো করে “অনলাইন শিক্ষা” নামে সম্পূর্ণ নতুন ধারায় এক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে শিশু থেকে সর্বশেষ বর্ষের শিক্ষার্থীও পরিচিতি হচ্ছে। কেউ যেন ঝরে না যায় তাই সরকারের এই উদ্যোগ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে গ্রহণযোগ্য এই ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীরা ইতিবাচক ও নেতিবাচক, এক দ্বিত্ব ফলাফলের সম্মুখীন  হচ্ছে।

আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি: বাবা মারা সবসময় চান তাদের সন্তান নিরাপদে থাকুক। তাদের এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ঘরে বসেই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব, পিসির মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার কথা বলেন। এতে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি আমাদের গুরুজন, শিক্ষকরাও আক্রমণের আশঙ্কা থেকে দূরে থাকছেন।

সহজলভ্যতা: একজন শিক্ষার্থী যখন শারীরিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করতো তখন তাকে বাইরে নানা পরিবেশ যেমন রোদ, বৃষ্টি, জ্যাম পেরিয়ে তাকে ক্লাসে উপস্থিত হতে হতো। ক্লাসের পেছনে বসার ফলে কেউ কেউ মনোযোগ ও হারিয়ে ফেলতেন বা বড় ক্লাসরুমে শুনতেও বেগ পেতে হতো। কিন্তু এখন আর তা নেই। নিজস্ব পরিবেশে ঝড়-ঝঞ্ঝা ছাড়াই সে ক্লাসে সময়মতো উপস্থিত হতে পারছে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও অনেকটা একরকম। তারাও নিজস্ব পরিবেশে নিজের মতো করে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারছেন। অনলাইনে একই বিষয়ের উপর সহজেই অনেক রেফারেন্স উপকরণ যেমন আনলিমিটেড পিডিএফ, ভিডিও ও অডিও কনটেন্ট  পেয়ে যাচ্ছে।

বাবা-মার সচেতনতা: অনলাইনে টিউটর বা শ্রেণি শিক্ষক পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিতে পারছেন না বিধায় অনেক বাবা মাই সন্তানের দিকে বেশি মনেযোগী হচ্ছেন। তাদেরকেও বাসা থেকে অফিসিয়াল কাজ করতে হয় দেখে সন্তানের জন্য যথেষ্ট সময় পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের সুবিধা, অসুবিধা এবং বাবা মাও শিক্ষকদের কাছে সন্তানের ব্যাপারে জানতে চান।

মনোযোগের অভাব : সরাসরি ক্লাসের আনন্দটাই আলাদা। শিক্ষার্থী চাইলেও যেন মনোযোগ আলাদা কোন ক্ষেত্রে দিতে পারবে না। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থীর কার্যকলাপ নিরীক্ষার কোন সুযোগ নেই। যার জন্য তারা যদি ভিডিও কলে জয়েন করে তবুও তারা পুরোপরি মনোযোগী হতে পারেন না। এমনও দেখা গিয়েছে স্টুডেন্ট অডিও কলে জয়েন করে অন্য কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে যায় যেমন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গেমিং। অথচ ফিজিক্যাল ক্লাসে শিক্ষকদের চোখে ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। শুধু ক্লাস নয়, পড়াশোনা করার প্রতিও স্টুডেন্ট এর আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

টেনশন, ভয়ভীতি: সরাসরি পরীক্ষায় চেয়ে অনলাইন পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভয়, টেনশন দ্বিগুণ। দু:চিন্তা যেন তাদের পিছু ছাড়েনা। পরীক্ষায় সময় পরীক্ষার ভালো মন্দ চিন্তা করার পরিবর্তে  ইন্টারনেট থাকবে কি না, সময়মতো সাবমিট করতে পারবে কি না, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস কোন ক্ষতির সম্মুখীন যেন না হয়, বৈদ্যুতিক কোন ক্ষতি, আবহাওয়ার ঠিক থাকা না থাকা এমন নানান ধরনের ভাগ্যমন্ত চিন্তাভাবনা করে থাকে। এতে করে ফলাফলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থীই জানায়, প্রায়ই তারা ডিভাইসের সমস্যার সম্মুখীন তো হচ্ছেই তার সাথে ক্লাসে টিচারদের আলোচনা নেটের কারণে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছে না৷ ঠিকভাবে পারফরম্যান্স দেখাতে পারছে না।

ক্লাস নিয়ে দুঃচিন্তা: একজন শিক্ষার্থী যখন সরাসরি ক্লাস করতো তখন সে কোন কারণবশত ক্লাস করতে না পারলেও তার সহপাঠীরা তার সহায় হিসেবে ছিলো। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাস করতে হয় বলে সে চিন্তা করে ক্লাসের সময় সে পুরোপুরি ভালো গতিতে নেট পাবে কি না! তার বন্ধুরা তাকে ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবে কি না!

জানার পরিধিতে বাধা: সরাসরি ক্লাসে শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকরা আলাদা অফিসের সময় দিয়ে থাকেন। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকেরাও ইন্টারনেটের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। যার কারণে তাদের অজানাগুলোকে জানার সুযোগও কমে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন করার ইচ্ছেও কমে যাচ্ছে।

পর্যাপ্ত ডিভাইস ও ইন্টারনেট কেনার অক্ষমতা: বর্তমানে করোনার কারণে সবার অর্থনৈতিক অবস্হা আরো খারাপের দিকে যাওয়ায় সবার পক্ষে একটা ভালো ফোন বা ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য হয়ে উঠেনা। যার কারণে এখনও গ্রামাঞ্চলে তো অবশ্যই তাছাড়াও শহরের দিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ঠিকমতো ক্লাসে জয়েন করতে পারে না। ঠিক তেমনি সবার ক্ষেত্রে বাড়তি নেটের লাইন বা জিবি কেনার সামর্থ্য হয়ে উঠেনা।

শারীরিক ক্ষতি: গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলে থাকেন, ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করা ঠিক নয়। অথচ বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সময় ধরে এসব ব্যবহার করছে। যার ফলে তারা চোখ, কানের সমস্যায় ভুগতে পারে।

গ্রুপ আলোচনার অভাব: কয়েক শিক্ষার্থীর থেকে আলোচনা করে জানতে পেরেছি তারা অনলাইন গ্রুপ স্টাডি থেকে অফলাইন স্টাডিতেই বেশি লাভবান হতো।

প্রাকটিক্যাল শিক্ষায় ব্যাঘাত: সাইন্সের বিষয়গুলো যেমন রসায়ন, বাইলোজি, ফিজিক্স ও ভার্সিটির কিছু বিষয় যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, জেনেটিক্স, মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা প্রাকটিক্যাল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব গ্রুপের স্টুডেন্টদের জন্য বইয়ের পরিধি থেকে ফিজিক্যাল পরিধিটা বেশি জরুরি। কিন্তু তারা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তাদের প্রাকটিক্যাল ক্লাসগুলোতে ব্যাপকভাবে ক্ষতি হচ্ছে।

একজন শিক্ষার্থী সবসময় চায়, সে জানো ক্লাসের সবার সাথে, সরাসরি শিক্ষকদের শাসন ও স্নেহের মাঝে ক্লাস করতে পারে। সেটা শিশু শ্রেণীই হোক বা একজন ভার্সিটি পড়ুয়াই হোক। নতুন এই শিক্ষাব্যবস্হাপনার সাথে মানিয়ে হিমশিম হলেও শিক্ষার্থীরা এটাকে ইতিবাচকভাবে মেনে নিতে শুরু করেছে অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও। প্রতিটা শিক্ষার্থীই অপেক্ষা করে আছে একদিন আগের মতোই হৈ-হুল্লোড়, শিক্ষকদের চোখ রাঙানি কিংবা মিষ্টি ভালোবাসার মাঝে ফিরে যাবে।

লিখেছেনঃ সামিহা আতিকা

RedLive

Related post