মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া ভাষা শহীদ যারা

২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিন সকল বাঙালি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে।
১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলার কিছু সোনার ছেলে মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে,স্পষ্টতঃ বলতে গেলে শহীদ হয়েছে।তারাই আমাদের কাছে ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিত। এসব ঘটনা আমাদের সবার জানা থাকলেও আমাদের ভাষা শহীদ আসলে কতজন সেটি আামাদের জানা নেই। আজ ৬৮ বছর পর এসেও সে তথ্য আমাদের কাছে অজানা। ভাষার ইতিহাস আমরা সবাই ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি যে, “২১ এ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবুল বরকত, রফিক, জব্বার, সালাম এবং ২২ এ ফেব্রুয়ারির শফিউর রহমান সহ আরও অনেকে”। কিন্তু ‘আর ও অনেকে’ বলতে আসলে কতজন? তখনকার পত্রিকা বা সরকার কারো কাছেই কি এর কোন হিসাব ছিল না? তার জন্যই হয়তো বা আজ পর্যন্ত সে ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অনেক প্রশ্ন থেকে গেছে।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ২১ ও ২২ শে ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক) আশপাশে, নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে গুলিতে কতজন মারা গেছেন, তার সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। ১৯৫২ সালের পাঁচজন শহীদের নাম আমরা বেশি শুনতে পাই, তাঁরা হলেেন: আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান। এরাই আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়া পাঁচজন ভাষা শহীদ। এর বাইরে আর কতজন মারা গেছে তা জানতে হলে আমাদের তখনকার পত্রিকা বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বইয়ের কাগজ উল্টাতে হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম স্মারকপত্রটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালের মার্চে (প্রকাশক-পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি মোহম্মদ সুলতান,সম্পাদক-হাসান হাফিজুর রহমান)। সেই বইয়ে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর ‘গায়েবি জানাজা’ পড়ানো হলো। পরদিন সকাল নয়টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং সংবাদ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের ওপর মিলিটারি বেপরোয়া গুলি চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে’।পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তার পাকিস্তানস আদার স্টোরি: দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন বইয়ে লিখেছেন, “পুলিশের গুলিতে ২৬ জন নিহত এবং ৪০০ জনের মতো আহত হয়েছিলেন”। বইটি ২০০৮ সালে লাহোরে প্রকাশিত হয়।হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবির উদ্দিন আহমদ তার ‘একুশের ইতিহাস’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আটজনের মৃত্যুর কথা সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়’। ধারণা করা হয় এই আট জন হলেন ২১ এ ফেব্রুয়ারীতে শহীদ-রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম ২২ এ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ-শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ, আব্দুল আউয়াল ও অজ্ঞাত বালক নামে একজন।(সূত্র-আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ওয়েবসাইট)। এছাড়া বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যম হতে সিরাজুদ্দিন ও সালাউদ্দিন নামের দুজনের কথা উঠে এসেছে। যার মধ্য হতে সালাউদ্দিনের কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতিচারণ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এবং পত্র-পত্রিকার সংবাদ থেকে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে স্বীকৃতি পাওয়া পাঁচজন ভাষা শহীদ ব্যতীত বাকিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের তালিকায় একজন ১০ বছরের (মতান্তরে ৯ বছর) কিশোর রয়েছেন; যার নাম হলো অহিউল্লাহ। অহিউল্লাহর বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। খুব গরিব ছিলেন তিনি। কিন্তু শত অভাব সত্ত্বেও তিনি তার ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি ছবি আঁকার দিকে প্রবল ঝোঁক ছিল অহিউল্লাহর। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় অহিউল্লাহ মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সেদিন (২২ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই পুরো শহরটা থমথমে। খুবই অল্প লোকজন রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করছিল। বালক অহিউল্লাহ ঢাকা শহরের এই থমথমে পরিবেশ দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল। তাদের এলাকায় নতুন আসা কিছু মানুষ নিয়েও সে খুব চিন্তিত! এসব খয়েরি রঙের পোশাক পরা, লম্বা লোকদের আগে কখনো এই এলাকায় দেখা যায়নি। এই অদ্ভুত লোকদের দেখে খুব মজা পেয়ে গিয়েছিল নবাবপুরের খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানো অহিউল্লাহ। সে ভাবতে লাগল, এদের কিভাবে ছবি আঁকার বিষয়বস্তু করে তোলা যায়। সে এত খুশি ছিল যে, এক টুকরা কাগজ মুখে পুরে সমানে চিবুতে লাগল। কিন্তু যাদের দেখে সে অবাক ও বিস্মিত তারাই তার শত্রু হয়ে গেল।হঠাৎ একটা রাইফেলের গুলি এসে অহিউল্লাহর কপাল দিয়ে ঢুকে গেল।মাটিতে পড়ে গেল সে। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ। এরপর সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এসে গরিব রাজমিস্ত্রির ছেলেটার লাশ নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। পুলিশ নিজেদের মতো করে অহিউল্লাহর লাশ দাফন করল, নাকি মাটিচাপা দিয়ে দিল- সে তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অহিউল্লাহর পকেটে পাওয়া গেল একটি রঙিন কাগজের টুকরো। যেখানে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু আর প্রজাপতির ছবি আঁকা ছিল। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় অহিউল্লাহর শাহাদাতের খবর ছাপা হয়। তার লাশটি পুলিশ গুম করে ফেলেছিল বলে কোথায় তাকে কবর দেয়া হয়েছে তা আজও অজ্ঞাত রয়ে গেছে। অহিউল্লাহর কোনো কবর নেই। তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছিল সেটাও কেউ জানে না। অহিউল্লাহর কবর কোথায় সে কথা জানতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের এম আর মাহবুব। লাশ দাফনের খাতায় তার নাম পেলেও তার কবর খুঁজে পাননি। ১৯৫৪ সালের শহীদ দিবস সংখ্যা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় শহীদ অহিউল্লাহর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছাপা হয়।
ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর মরদেহ প্রত্যক্ষকারী ছিলেন তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভাষাসংগ্রামী ডা. মেজর (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেইদিনই (২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) দুপুর বেলায় নবাবপুর রোডের মানসী হলের সম্মুখে স্কুলের ছাত্রদের একটি মিছিলের উপর টহল মিলিটারির গাড়ি হইতে গুলি ছোড়া হয়। সেই জায়গায় অহিউল্লাহ নামে ৯-১০ বয়সের একটি ছাত্র গুলিবিদ্ধ হইয়া মারা যায়। তাহার লাশ মেডিকেল মর্গে দেখিয়াছি। বুকের পকেটে তাহার নিজ হাতে থাকা প্রজাপতি সংবলিত এক টুকরা কাগজ ছিল।’ (সূত্র : আমার জীবনের সত্তর বছর-পৃ-২৮)।ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ সম্পর্কে গবেষক, লেখক ও কথাশিল্পী বশীর আল হেলাল ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে (পৃ: ৪৮৩) সাপ্তাহিক নতুন দিনে প্রকাশিত খবরের উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘অহিউল্লাহ নামক ৯ বছরের একটি ছেলের মৃত্যুর খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। অন্য কয়েকজন শহীদের পরিচয়ের সঙ্গে অহিউল্লাহর শাহাদাতের খবরটি রয়েছে ১৩৬২ সালের ১১ ফাল্গুনের সাপ্তাহিক ‘নতুন দিনে’। এতে কেবল এইটুকুই বলা হয়েছে যে, রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে হঠাৎ মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে নিহত হয় এবং তার লাশ অপসারিত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘বর্ণমালার গল্প: অ-তে অহিউল্লাহ’ শীর্ষক এক লেখায় সেলিনা হোসেন ভাষাশহীদ অহিউল্লার কথা উল্লেখ করেছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠের শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন ‘টুনটুন টিনটিন’ এ প্রকাশিত ‘অহিউল্লাহকে সবাই ভুলে গেছে’ শিরোনামে ওমর শাহেদ লিখেছেন তার সম্পর্কে। নানাজনের কাছ থেকে অহিউল্লাহর শারীরিক বিবরণের কথা শুনে শুনে ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের উদ্যোগে আঁকা হয়েছে অহিউল্লাহর ছবি। ২০০৭ সালে ছবিটি আঁকেন চিত্রকর শ্যামল বিশ্বাস। এই ছবিটিই ভাষাশহীদ অহিউল্লাহর একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন।
ভাষাশহীদ আবদুল আওয়াল

ভাষাশহীদদের তালিকায় আবদুল আওয়ালের নামটি বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। সেদিন (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে একুশের ভাষাশহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্যারাক হোস্টেল প্রাঙ্গণে। উক্ত জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন আবদুল আওয়াল। জানাজা শেষে বিশাল শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই শোক মিছিলেও অংশ নেন তিনি। মিছিলটি যখন কার্জন হলের সামনের রাস্তা অতিক্রম করছিল, তখন অতর্কিতভাবে একটি মিলিটারির ট্রাক মিছিলের এক পাশে উঠিয়ে দেয়া হয়। ট্রাকের আঘাতে সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন রিকশাচালক আবদুল আওয়াল। সরকারি প্রেস নোটে অবশ্য বলা হয়েছে, এটা নেহায়েত একটা সড়ক দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, শোক মিছিল ছত্রভঙ্গ করতেই সরকারি নির্দেশে মিছিলের উপর দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর ট্রাক চালিয়ে দেয়া হয়েছিল ফলে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে শহীদ হয়েছিলেন তিনি।
ভাষাশহীদ আবদুল আওয়াল সম্পর্কে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, দৈনিক আজাদ এবং দৈনিক মিল্লাতে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, ‘২২ ফেব্রুয়ারি রিকশাচালক আবদুল আওয়াল মিলিটারির ট্রাকের আঘাতে নিহত হন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ হালিম। তাকে আজিমপুর গোরস্তানে সরকারি তত্ত্বাবধানে অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত করা হয়।’ (সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসংগ্রামীগণ পূর্বোক্ত পৃ-২৬)। বশীর আল হেলাল ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৪৮৩) বলেন, “আবদুল আওয়াল সম্পর্কে উক্ত সরকারি বিবরণে বলা হয় : “মোহাম্মদ হাশিমের ছেলে মোটর দুর্ঘটনার মারা যায়। জনাব ওবায়দুল্লার উপস্থিতিতে তাহার জানাজা পড়া হয়”। ১৪ মার্চ, ১৯৫২ইং তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, “আবদুল আওয়ালের পিতার নাম মোহাম্মদ হালিম। মোটর দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জনাব ওবায়েদউল্লার উপস্থিতিতে মাওলানা আব্দুল গফুর তার জানাজা পড়ান”। ২৫ মার্চ, ১৯৫২ইং তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ- “আবদুল আওয়াল, ঈ/ঙ মোহাম্মদ হালিম। তাহার বয়স ২৬ বৎসর। সে রিকশা চালাইত এবং ১৯ নম্বর হাফিজুল্লা লেন মৌলভী বাজার ঢাকায় বাস করিত। মোটর দুর্ঘটনায় তাহার মৃত্যু হয়। জানাজার সময় তাহার কোন আত্মীয় উপস্থিত ছিল না। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা জনাব ওবায়েদউল্লা জানাজার সময় উপস্থিত ছিলেন”।এভাবে বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যম হতে তার মৃত্যুর খবর উঠে এসেছে।
ভাষাশহীদ সিরাজুদ্দিন

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিরাজুদ্দিন নবাবপুরে ‘নিশাত’ সিনেমা হলের বিপরীত দিকে মিছিলে থাকা অবস্থায় টহলরত ইপিআর জওয়ানের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।দৈনিক আজাদের প্রতিবেদনে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর রয়েছে। সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়া ছিলেন ভাষাশহীদ সিরাজুদ্দিন এর মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষকারী একমাত্র সাক্ষী। এ সম্পর্কে তখনকার কোনো প্রতিবেদন বা পত্রিকায় এর বেশি কিছু ছাপা হয়নি।তবে তার সম্পর্কে তথ্য সন্ধানে ভাষাসংগ্রামী, লেখক ও গবেষক আহমদ রফিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।আহমদ রফিক ১৯৭২ সালে নান্না মিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে ভাষাশহীদ সিরাজুদ্দিন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। উক্ত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে আহমদ রফিক ‘ইতিহাস : মিছিলে হারানো নাম’ শিরোনাম একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটি ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হলো :
“বাইশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) দিনটি বাস্তবিকই ছিল কল-গর্জন-মুখর। বিশাল ধনুকের ছিলার মতো টান টান। ইস্পাতের ঝলসানি নিয়ে নিষ্ঠুর রোদ সকাল থেকেই হেঁটে বেড়াচ্ছিল কালো পিচের ওপর। সামরিক বাহিনী মোতায়েন, ১৪৪ ধারা, কার্ফ্যু ইত্যাদি কিছুই যেন শহরটিকে স্পর্শ করছে না। স্বতঃস্ফূর্ত জলপ্রপাতের মতো মানুষ সব কিছু অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে পড়েছে।সে দিনের ঢাকা ছিল মিছিলের শহর।মিছিলে ভেসে নিজের অজান্তেই সদরঘাট বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছে যায় নান্না। একটু এগোয় সে, রথখোলার মোড়ে ট্রাক ভর্তি সামরিক বাহিনীর জওয়ান সশস্ত্র, উদ্যত, যেন কারো প্রতীক্ষায় তৈরি, পেছন ফেরে সে। মিছিল আসছে একটা বাহাদুর শাহ পার্কের দিক থেকে। চারজনের সারিতে বিন্যস্ত বলিষ্ঠ পৃথুল অবয়ব, স্লোগানে, গর্জনে দৃপ্ত পদক্ষেপের ভঙ্গিতে যেন একটি সশস্ত্র জলপ্রপাত। মনে সাহস জোগায়।কী এক আকর্ষণে মিছিলে নেমে পড়ে নান্না। সুদীর্ঘ বিশাল জনস্রোত এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে দ্রুত পায়।কিছু দূর এগিয়ে যেতেই ওর চোখে পড়ল উত্তর দিক থেকে সৈন্য বোঝাই একটি ট্রাক আসছে, তখনি পেরিয়ে যাচ্ছে মিছিল। কিন্তু না,চৌধুরী সাইকেল কোম্পানি বরাবর এসে হঠাৎ সেটা থমকে দাঁড়াল। জওয়ানগুলোকে পজিশন নিতে দেখেই চমকে উঠে নান্না। ওর সজাগ দৃষ্টি বরাবরই ন্যস্ত ছিল ওদের উপর। ঘাড় বাড়িয়ে দেখে মিছিলের মুখ ইতিমধ্যে মতিলাল পেরিয়ে গেছে। মিছিল দ্রুত এক সারিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিজেদের বিন্যস্ত করার কাজ শেষ হওবার আগেই সশস্ত্র গর্জনে আসে মৃত্যু -এরই মধ্যে কখন যেন নিশাত সিনেমার গলিতে ঘাপটি মারা জওয়ান ও পুলিশ দল রাস্তার ঠিক মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক মিছিলের পাশেই কয়েকজন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে আর তক্ষুনি ধুপধাপ ট্রাক থেকে নেমে এল কয়েকটি সশস্ত্র জওয়ান, পাশ থেকে কয়েকজন পুলিশ। উদ্দেশ্য মুমূর্ষু বা আহতদের নিয়ে পালাবে। কিন্তু ক্ষিপ্ত জনতা ছেড়ে দেবে না ওদের। আরো কয়েক রাউন্ড সশব্দ ঝলকানি। স্টুডিও এইচ এর বন্ধ দরজা এবং সামনের লাইটপোস্টটির দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে কোন দিক দিয়ে যেন বেরিয়ে গেলো। মিছিলে বিশৃঙ্খলা জেগে উঠেছে। ওর আশেপাশে এখন কোলাহল স্লোগান ইতস্তত ছোটাছুটি। এত সশব্দ গর্জনের মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল পাশেই জোয়ান একটি ছেলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে। বুকটা ধপ করে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে কালো পিচের সাদা শার্ট-প্যান্ট ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছে। কোমরের ঠিক উপরে লেগেছে গুলিটা। কে যেন আটকে দিয়েছে নান্নার পা দুটো। নুয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল নাম। জবাব এলো এক অচেনা স্বরধ্বনিতে : সিরাজুদ্দিন, বাসাবাড়ি লেন… ইত্যাদি। কিন্তু কীভাবে তাকে বাঁচাবে? একে কেমন করে হাসপাতালে পাঠাবে?ঝিমিয়ে পড়ছে সিরাজুদ্দিন। জামাটা আরো লাল, মুখটা সাদা বিবর্ণ। নান্না এখন যেন আর মিছিলে নেই, ওর কানে ভাসছে ছেলেটির হতাশ কণ্ঠস্বর, চেনা পরিবেশে ফিরে যাবার ব্যাকুলতা, সিরাজুদ্দিনের রক্তমাখা শার্ট হাওয়ায় উড়ে মিছিলের পথ দেখাচ্ছে।সিরাজুদ্দিনের শার্ট মিছিলের মুখে রক্তিম পতাকা, তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে নিয়ে চলল, ওর শেষ কথাগুলো তার কানে জল তরঙ্গের মতো বেজে চলেছে। সিরাজুদ্দিন আরো অনেকের সাথে একাকার হয়ে মিছিলের মুখ হয়ে গেছে।” সেই সিরাজ্জদ্দিন সম্পর্কে আর কোনো সন্ধান করা হয়নি।
অজ্ঞাত বালক
ধারণা করা হয়,সে ২২ ফেব্রুয়ারি সম্ভবত কার্জন হল এলাকায় মোটর গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে।বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রতিবেদনে তাকে “অজ্ঞাত বালক”হিসেবে সমোদ্ধন করে তার মৃত্যুঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।তার পরিচয় বা তার সম্পর্কে কিছুই আজ পর্যন্ত জানা যায় নি।তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে শোক মিছিল বেরিয়েছিল এই অজ্ঞাতনামা বালক ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিল। মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য মিছিলের মধ্যখানে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী ট্রাক চালিয়ে দিলে এই অজ্ঞাতনামা বালকটি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।তার সম্পর্কে এর বেশি তথ্য তখনকার কোনো প্রকাশ মাধ্যম বা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়নি।
মহান ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হলেও তারা সবাই স্বীকৃতিও পাননি। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। খবরে বলা হয়েছে, মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত: ৩ শতাধিক আহত। তাছাড়া দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।অনেক আহত ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন যাদের পরবর্তীতে আজিমপুর কবরস্থানে গণকবর হয়।ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’; আবার অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবত ৬ জন নিহত হয়’ উল্লেখ করা হয়।১৯৫২ এর ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কনসাল জেনারেল বোলিং তার তারবার্তাগুলোতে দুদিনে নিহতের সংখ্যা ১৪ র বেশি উল্লেখ করেছেন।যদিও এই তথ্য পরবর্তীতে সরকার অপপ্রচার বলে দমিয়ে দিয়েছে। এভাবে বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকা হতে ২১ ও ২২ শে ফেব্রুয়ারিতে আহত-নিহত সংখ্যার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।এর মধ্যে সঠিক তথ্য কোনটি বা কেন বাকি শহীদরা স্বীকৃতি পায়নি সেই প্রশ্নের উত্তর আজ ও বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে নি।
আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদ আসলে কতো জন এই তথ্য চিরকাল অজানা থেকে যাবে যদি সরকার সংরক্ষিত তথ্যাদি প্রকাশ না করে। বর্তমান প্রজন্ম এই সংখ্যাটি জানতে আগ্রহী। কেননা ভাষা আন্দোলন থেকেই আমাদের জাতীয়তাবোধ জন্মে, আমরা স্বাধীনতার বীজ অন্তরে গাঁথি।
লিখেছেনঃ মারজানা পূর্ণতা
ফিচার ইমেজঃ
ক্রিয়েটেড বাই
হাসিন মাহতাব
All rights reserved by RED LIVE