মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা-রোকসানা আকতার

উদ্যোক্তা রোকসানা আকতার। নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করার অল্প দিনের মধ্যেই বেসরকারী চাকুরীতে জয়েন করেন।শুরুটা হয়েছিলো ফ্রীল্যান্সিং কাজ দিয়ে একটা বেসরকারী টিভি চ্যানেলে, এরপর আরো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, পরে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। চার বছরের চাকুরী জীবনকে পিছে ফেলে হাজবেন্ডের চাকুরীর সুবাদে ঢাকা ছেড়ে চলে যান ময়মনসিংহ। কিন্তু রোকসানা আকতার তাঁর স্বপ্নের কাছে কখনোই হার মানতে রাজি নন।এই বর্নাঢ্য জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া তাকে সব সময় ভাবাতো।সেই চিন্তা ভাবনা থেকে তিনি পথ বেছে নেন অনলাইনে চার রকমের দেশীয় খাদ্য পন্য নিয়ে কাজ করা শুরু করেন।তার উদ্যোগের নাম মাটির ফুল অর্গানিক।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলার প্রতিনিধি রোয়েনা রহমান।
কেন আপনি উদ্যোক্তা হলেন? এবং উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনের কারন কি?
ছোটবেলায় আমাদের মেয়েদের একটা সাধারণ ইচ্ছে থাকে ডাক্তার হবো, আসলে পরিবার তাই চায়। তারপর কেউ হতে পারে আবার কেউ পারে না। আমি মনে করি, না পারা টা ব্যার্থতা নয়,শেষ হয়ে যাওয়া নয়। ব্যার্থতা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর আর একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়।
সবার আগে আমাদের মানে পরিবারের জানা দরকার একজন মেয়ে কি হতে চায়, তার কি ভালো লাগে। তার কিসে আগ্রহ বেশি বা আগ্রহ তৈরি হোক এমন কাজে উৎসাহ দেয়া উচিৎ যদিও এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আমরা না করে আমাদের মনগড়া ইচ্ছে সন্তানের উপর চাপিয়ে দেই। (এটা ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে) এতে অনেকে হতাশায় ভোগে। না হতে পারলে পরিবার তাকে কিভাবে দেখবে এই যন্ত্রনা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়েও প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে এই সাবজেক্টে পড়ে কি হবে, এটা আবার কোন বিষয় নাকি আর প্রতিনিয়ত এসব কথার প্রতিবাদ করলেও মানসিক ভাবে কিন্তু খুব কষ্ট হতো। তবুও থেমে যাই নি।
চাকুরী ছেড়ে আসার পর শুরু হয় অন্যরকম পথ চলা, একঘেয়ামী ও হতাশা ভর করে। ভেবেছিলাম সংসার ও সন্তান এসবে সময় ব্যয় করলে বুঝি আগের জীবন সব ভুলে যাবো কিন্তু আসলে এমনটা হয় না। আমি ভুলতে পারিনি।
প্রত্যেকটা মানুষের এসবের বাইরেও নিজের একটা জগৎ থাকা দরকার। সেই জগত হবে তার কর্মের মাধ্যমে নিজ নামে পরিচিত। অনেক সময় আমরা অনেকে নিজের ভালো থাকা বুঝলেও অন্যেরটা বুঝি না। আর এ কারণে শুরু হয় পিছিয়ে যাওয়া আর মানসিক অশান্তি।
সারাদিন কাজের ফাঁকেফাঁকে অনলাইনে অনেকের কাজ দেখতাম। চোখের সামনে অনেক মেয়ের সফলতা দেখে মনে হতো আমিও কিছু করবো,আমিও পারবো। চাকুরী জীবনের শুরুতে একটা ভালো চাকুরীর সুযোগ মিস করে ভুলে পরি। সেটা আমাকে কষ্ট দেয়। আর চাকুরী জীবনটাকে খুব মিস করতাম। এমন একটা জায়গায় থাকি সেখানে আমি যেমন চাকুরী চাই সেটা হওয়াও সহজ নয়। তাই নিজেই কিছু শুরু করবো এই চিন্তা করি।
২০২০ সালের জুলাই মাসে Woman & e-Commerce Forum (WE) এই গ্রুপটির দেখা পাই। এই গ্রুপের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা যার জন্য উইকে পেয়েছি। তিনি মূলত মেয়েদের কথা চিন্তা করেই গ্রুপটি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।
আমি যেভাবে কাজ করতে পছন্দ করি যেমন লিখতে ও পড়তে এই গ্রুপের কাজও তাই বিভিন্ন কনটেন্ট লেখা ও পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরে ব্রান্ডিং করতে হয়। সুশৃঙ্খল ও উদ্যোক্তাবান্ধব এই গ্রুপকে পেয়ে মনে হলো পুনরায় একটি সুযোগ পেলাম ঘুরে দাঁড়ানোর। এভাবেই আমার উদ্যোক্তা জীবন উইয়ের সাথেই শুরু।
আপনি কি কি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করেন?
আমি মূলত চার রকম দেশি খাদ্য নিয়ে কাজ করি।যেমন-আখের রস থেকে হাতে তৈরি অপরিশোধিত ব্রাউন চিনি আমার সিগনেচার পণ্য। এই দেশীখাদ্য শত বছরের ঐতিহ্যকে লালন করছে একে আখের চিনি বা গুড়ের চিনিও বলে যা বর্তমানে মাটির ফুল অর্গানিকের নিজ তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে।
এছাড়াও আরো একটি দেশি খাদ্য নিয়ে কাজ করছি তুলশীমালা আতপ চাল। শেরপুর জেলার কৃষকের থেকে ধান সংগ্রহ করি এরপর নিজে শুকিয়ে সাধারণ ছোট মিলে ভাঙ্গিয়ে খুব ভালো করে ঝেরে প্যাকেজিং করি। ব্রাউন চিনি ও তুলশীমালা চাল দুটোর ক্ষেত্রেই সবচেয়ে যা প্রাধান্য দিচ্ছি তাহলো এর গুণগত মান যেন অক্ষুন্ন থাকে।

এরপর উদ্যোগে সংযোজন হয় ফুলবাড়িয়ার পাহাড়ী হলুদ গুড়া মসলা ও চৌরা দেশী লাল মরিচের গুড়া।
ব্রাউন চিনি আমার উদ্যোগের ক্রেতার মাধ্যমে জার্মানী ও ইটালি গিয়েছে। ক্রেতাদের ভালো ভালো রিভিউ ও ফিডব্যাক আমার কাজের অনুপ্রেরনা।
ব্রাউন চিনি,তুলশীমালা চাল, হলুদ ও মরিচ গুড়ার প্যাকেজিং করেছি পাট ও কাপড় দিয়ে যা করতে গিয়ে পরিবেশবান্ধব যেনো হয় সেই বিষয়টি খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছি।
উদ্যোক্তা হতে গিয়ে কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন কিএবং সবচেয়ে কার সাপোর্ট পেয়েছেন বেশী?
“স্বপ্ন দেখতে হলে আকাশের সমান দেখো,অর্ধেকও যদি পূরণ হয় সেও তো অনেক”। আমি কিছু করতে চাই এই স্বপ্নকে কখন থেমে যেতে দেই নি তাই হয়তো পুনরায় শুরু করতে পেরেছি।
উদ্যোগ গ্রহণ খুব কঠিন কাজ, ভালোবেসে এই কঠিন কাজকে জয় করতে চাই। একজন নারীকে সবসময় একটু বেশী পরিশ্রম করতে হয় সংসার, সন্তান সামলে কিছু করবার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তুলতে সবার আগে নিজেই নিজেকে টেনে তুলতে হয়। আমার মেয়ে কে দেখলে খুব নিজের মধ্যে একধরণের তাগিদ তৈরি হয় যে আমাকে কিছু করতেই হবে। প্রথমত মানসিক ভাবে বাধা তো ছিলোই যা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে।
তবে আমার পরিবার ও হাজবেন্ডকে সাথে পেয়েছি আমার উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
উইয়ের সাথে আমার পথ চলা জুলাই ২০২০ থেকে হলেও মাটির ফুল অর্গানিকের পথচলা শুরু হয় আগস্ট থেকে। আট মাসের উদ্যোক্তা জীবনে এর মধ্যে অনেক ভালো সারা পেয়েছি আমার সম্মানিত ক্রেতাদের কাছে। বর্তমানে মাটির ফুল অর্গানিকের ক্রেতা সংখ্যা ২০০ জন ছাড়িয়েছে এবং সেল এক লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছে। আমার ইচ্ছে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া। মানুষকে ভেজালের ভীড়ে ভালো খাবারের নিশ্চয়তা দিতে চাই। আমার উদ্যোগ দিয়ে আমি যেমন সমৃদ্ধ হবো সেই সাথে সমাজের মানুষের যেনো উপকারে আসতে পারি সেই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছি,কাজ করে যেতে চাই।