মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
চার হাজার টাকার মূলধনে এক বছরে দশ লক্ষ টাকা সেল করেছেন রুপা রানী বিশ্বাস

উদ্যোক্তা রূপা রানী বিশ্বাস। বর্তমানে বসবাস করছেন সাভার, ঢাকায়। ২০১১ সাল থেকে বরের চাকুরির সুবাদে এখানেই বসবাস শুরু করেন। ২০১৫ সালে বস্ত্র পরিচ্ছদ ও বয়ন শিল্পের উপর অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকুরির চেষ্টা শুরু করেন এই নারী। লিখিত ও ভাইবা পর্যন্ত গিয়ে ফেরত এসেছিলেন শূণ্যহাতে।
এদিকে ২০২০ সালে চাকুরির বয়স শেষ হয়ে গেলে মানসিকভাবে প্রায় ভেঙে পরেছিলেন। এছাড়া ছোট বাচ্চা থাকায় শহরের বাড়িতে নিরাপত্তার অভাবে সন্তান রেখে দূরে গিয়ে চাকরি করার সুযোগও সৃষ্টি করতে পারেননি । বাসার ঠিক পাশেই মোটামুটি ভালো মানের একটা স্কুলে জয়েন করেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে।কিন্তু করোনাকালীন প্রভাবে মার্চেই সব বন্ধ হয়ে যায়।
আবারো পুরনো হতাশা গ্রাস করতে শুরু করলো। এক সময় ক্ষুভ থেকে বলেন,এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে, ফলাফল ভালো করে কি লাভ হলো? বয়স শেষ হয়ে গেল অথচ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলাম না। তাছাড়া পরিবার, সমাজ আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবার কাছে নিজেকে ছোট মনে হতে লাগলে তার। কিন্তু নিজের যে প্রবল ইচ্ছে আছে কিছু করার তাই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য করে তুলেন অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান “সর্বাঙ্গিনী”।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলার প্রতিনিধি রোয়েনা রহমান।
কিভাবে আপনার উদ্যোক্তা পথ চলা শুরু হয়?
গৃহবন্দি জীবনে ছেলের দেখাশোনা আর মোবাইল চালানো ছাড়া কোন কাজই ছিল না। এর মধ্যে আমার এক মাসতুতো দিদি উইতে ইনভাইট করলেন, আমি ৩১ শে মার্চ ২০২০ এ উইতে জয়েন করি। কিছুদিন উইয়ের কার্যক্রম দেখেন। অন্যান্য উদ্যোক্তাদের কাজের আগ্রহ আর চেষ্টা দেখে নিজেও আগ্রহী হয়ে ওঠি। এক পর্যায়ে নিজেও সিদ্ধান্ত নেই উদ্যোক্তা হবার কিন্তু কি নিয়ে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। উইতে সময় দেয়ার সুবাদে অনলাইন আড্ডার সাথে পরিচিত হলাম এবং একদিন অনলাইন আড্ডায় জয়েনও করি। অন্যদের কথা বলা দেখে নিজেও সাহস করে রাজিব আহমেদ স্যার ও নাসিমা আক্তার নিশা আপুর সাথে কথা বলার সাহস সঞ্চয় করলাম। আমার জীবনের লড়াকু গল্প শুনে দুজনই অনুপ্রাণিত করলেন উদ্যোক্তা হবার এবং আমি কি নিয়ে কাজ করতে চাই তাও শেয়ার করলাম। দুজনই সমানভাবে সাপোর্ট করলেন। আমি জানালাম আমি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কাঁসা পিতলের পন্য নিয়ে কাজ করতে চাই, যদিও তখন কোন সোর্চ বা এসব পন্য সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে মন কেন জানি বারবার সাপোর্ট করছে এগুলো নিয়ে কাজ করতে।সেই থেকে উদ্যোক্তা পথ চলা শুরু।
উদ্যোক্তা হিসেবে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে?
সময়টা সত্যিই ভয়ানক ছিল। চারিদিকে লকডাউন, ঘর থেকে বের হওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। আবার হাতেও নিয়েছি চ্যালেঞ্জিং কাজ। বর লকডাউনে অফিসের কোয়ারাইন্টাইনে ছিল, তাই বাঁধা দেয়ার কেউ ছিল না।একদিন ছেলেকে একা বাসায় রেখে সাহস করে পাড়ি দিলাম ধামরাইয়ের এই গ্রাম থেকে সেই গ্রামে। হাতে ছিল মাত্র চার হাজার টাকা, তাও সংসারের। বর বাসায় নেই, আহামরি বাজারের চাপও নেই। তাই এই টাকা নিয়েই বেরিয়ে পরলাম। দিনশেষে তিনহাজার টাকার পন্য আর আনুষঙ্গিক খরচবাবদ এক হাজার ছিল সেটাও শেষ করে বাসায় ফিরলাম।
পরদিন থেকে শুরু হলো উইতে প্রচার। প্রচারের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য গুগলে রাতজেগে পড়া শুরু করলাম।কাঁসা পিতলের নানাদিক, ব্যবহার, পরিচর্যা, উপকারিতা ইত্যাদি নিয়ে ক্রমাগত লিখে যেতে থাকলাম। প্রথম এক দেরমাস কোন সেলই হয়নি। প্রায় দের মাস পর প্রথম অর্ডার আসলো। এদিকে উইতে দিনরাত সময় দিচ্ছি। টানা তিনমাস কয় ঘন্টা ঘুমিয়েছি জানিনা। এই পরিশ্রমের ফলও পেতে শুরু করলাম, শীঘ্রই লাখোপতির খাতায়ও নিজের নামটি যুক্ত করে ফেললাম।
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার ভূমিকা কি?
উই আমাদের পরস্পরের সহযোগী হবার যে মনোভাব তা সৃষ্টি করেছে। প্রথমেই যারা কিছুটা সফল তারা যেন একই এলাকার অন্যান্য উদ্যোক্তাদের পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী দাঁড়ায়। সেই কথা অনুযায়ী আমার সাভারে প্রায় বেশির ভাগই নতুন উদ্যোক্তা হবার দরুন উইতে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কিভাবে নিজের পরিচিতি তৈরি করবে, কিভাবে পার্সোনাল ব্রান্ডিং তৈরি করবে বা একে অপরের সহযোগী হবে সেই বিষয়ে সবসময়ই চেষ্টা করে আসছি। তাছাড়া লাখোপতি হতে সাহায্য করা, প্রথম ক্রেতা হয়ে অনুপ্রাণিত করা এগুলো আমার কাজের সবচেয়ে বড় অংশ। তাছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পন্যই আমি সবার আগে আমার এলাকার উদ্যোক্তাদের থেকে নেই, তাদের সাপোর্ট করি।সাভারের উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের পরিচিতি ও উইতে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সাভারের নাম তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
এর মধ্যে আবার আমার এগারোতম অপারেশনও হয়ে গেল, কাঁধে টিউমারের মত কিছু একটা দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তাই সময় সুযোগ করে অপারেশনটাও করিয়ে ফেললাম। অপারেশনের সাতদিনের মাথায় নিজে গিয়েই উইজননীর বাসায় পার্সেল দিয়ে আসলাম আর মিষ্টিমুখখানা দেখে শান্তি নিয়ে এলাম। সবাই হয়তো ভাবছেন, এত অপারেশন কেন??
বিয়ের ছয়মাসের মাথায় ২০১১ সালের ১০ ই জুন অসাবধানতাবশত রান্নার সময় আমার গায়ে আগুন লেগে যায়। তাৎক্ষণিক ৩৫% পুড়ে যায়। হসপিটালে দীর্ঘ তিনমাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে মায়ের বুকে ফিরে আসতে সক্ষম হলাম, যেখানে বাঁচার আশা নাকি ১০% ও ছিল না। এই তিনমাসে আটবার অপারেশন হয়, পুড়ে যাওয়া ক্ষত সাড়ানোর জন্য ৩৫% ক্ষত পূরনে আরো ২০% স্কিন নেয়া হলো শরীরের অন্যান্য ভালো অংশগুলো থেকে।মোটামুটি সুস্হ হয়ে বাসায় ফিরলেও ভঙ্গুর মনকে আরো ভেঙে দিতে পাড়াপ্রতিবেশিদের আনাগোনা শুরু হলস পুরোদমে। তাদের কৌতুহল আমার জীবনকে বিষাক্ত করতে লাগলো। মনে হতো মৃত্যুই ভালো ছিল, অসুন্দর মুখ নিয়ে এই সমাজে বাঁচা যাবেনা।
এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করলেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। ২০১২ সালের আগস্টের ৬ তারেখ কোলজোড়ে এল একখন্ড চাঁদ।সেও আবার সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে। জীবনটাই বদলে গেল,কঠিন হয়ে গেল প্রতিটি ধাঁপ। স্বামী চাকুরিজীবী, সংসারে সময় দিতে পারেনা। এদিকে বাচ্চা, সংসার অন্যদিকে পড়াশোনা। সাভার থেকে ঢাকায় গিয়ে ক্লাস পরীক্ষা সবকিছু সামলেছি অনেক ধৈর্য্য নিয়ে তবুও একবছরও গ্যাপ দেইনি। বাচ্চাকে কখনো আমার সাথে নিয়ে গেছি কখনোবা প্রতিবেশির কাছে রেখে গেছি।পরীক্ষার সময় বড়বোনের বাসায় রেখে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। বাচ্চাটাও আমার সুপার হিরো, কখনোই কাউকে বিরক্ত করতো না।
পুড়ে যাওয়া ক্ষত সারাতে আটটা অপারেশন তো হলো কিন্তু গলার স্কিন ঠিক করতে পারেনি। এদিকে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বর আমাকে জীবনসঙ্গী করায় শ্বশুরবাড়ির কোন সাপোর্ট কোন বিপদেই পাইনি বরং সংসারে নানা ঝামেলা লেগেই ছিল।তারমধ্যে সুন্দর বউ অসুন্দর হয়ে গেল। এই বউ নিয়ে নাকি সমাজে ওনাদের চলতে লজ্জাবোধ হয়।
তাই দিকনির্দেশনাগুলো পর দিন শহরেই রয়ে গেছি, শ্বশুরবাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হয়নি। বর ঠিক ছিল বলেই হয়তো প্রাণটাও শেষ পর্যন্ত সার্বভাইভ করে টিকে ছিল।একে তো শরীর পুড়ে এত অপারেশন হলো তারমধ্যে ২০১৮ সালে বামকানেও মারাত্মক ইনফেকশন দেখা দিল।দীর্ঘ ছয়মাস চিকিৎসা নিয়েও ভালো হয়নি বরং মারাত্মক আকার ধারন করলো। তাৎক্ষণিক অপারেশন করা দরকার।যেখানে প্রথমে গলার স্কিন ঠিক করার জন্য ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা ছিল সেখানে কানের অপারেশনই ইন্ডিয়া গিয়ে আগে করাতে হলো। পরের বছর ২০১৯ সালেজানুয়ারিতে আবারো গলার স্কিন গ্রাফটিং এর জন্য ইন্ডিয়া যেতে হলো। অপারেশন এটাও আশানুরূপ হয়নি বরং অপারেশনের পরবর্তীধাপে আরো অসুস্হ হয়ে পরি। এবারও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি বলা চলে।
এদিকে চিকিৎসা, সংসার, সন্তান, পড়াশোনা সবকিছু তো চলছিল কিন্তু পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে পারিনি। পড়াশোনা করে আশানুরূপ ফল পাইনি বলেই উদ্যোক্তা জীবনে সিরিয়াসলি কাজ করার ব্রত নিয়েছি। যার ফলশ্রুতিতে একবছরের পরিশ্রমে ১০,১৩,৪৫০ টাকা এখন পর্যন্ত সেল করতে পেরেছি।যখন থেকে অর্থ উপার্জন শুরু করি তখন থেকে পারিবারিক ঝামেলাগুলোও কমতে শুরু করলো। উই থেকে শুধু অর্থ আসেনি পেয়েছি শক্ত মনোবলও। যার কারনে এখন বুক ফুলিয়ে চলতে পারি, স্বাধীনভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারি। যার পুরো ক্রেডিট হচ্ছে উইয়ের।
আপনি কি কি পণ্য নিয়ে কাজ করছেন?
আমার উদ্যোগের নাম “সর্বাঙ্গিনী “।আমার উদ্যোগের পন্য কাঁসা পিতল ও তামার নানা জিনিস।
প্রাথমিকভাবে এগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে এবং অত্যন্ত দামী। তাই চাইলেও কেনার সামর্থ্য সবার নেই। তবুও আমার প্রচার প্রচারণায় এ পর্যন্ত প্রায় চারশত পরিবারে আমার উদ্যোগের পন্য পৌছে গেছে, প্রায় ৫০ টি জেলায় আমার পন্য পৌঁছাতে পেরেছি। অনেক উদ্যোক্তার মধ্যে এগুলো নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমি যখন কাজ শুরু করি তখন অনলাইন জগতে এসব পন্যের এত পেজ ছিল না। যা আজ বহুগুণে বেড়েছে।আজকাল অনেক পরিবার সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে এসব পন্য ব্যবহার শুরু করেছেন। এভাবেই আমার কাজ স্বার্থকতায় রূপ লাভ করছে।

আপনার উদ্যোগটি নিয়ে আপনার ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কি?
আমার স্বপ্ন শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হওয়া নয়, ঐতিহ্যবাহী দেশীয় পন্যের মর্যাদা পুনরায় ফিরিয়ে আনা। বিলুপ্ত শব্দের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য পন্যের মর্যাদা দেয়া।তবে আমার একার প্রচেষ্টায় সেটা সম্ভব না। এরজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এতে করে দেশীয় পন্য রক্ষা পাবে অন্যদিকে ব্যবহার যত বাড়বে দাম ততই কমবে আর রোগব্যাধিও কম হবে।