মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
জ্যোতির্বিজ্ঞানঃ এক অনন্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিগ্রহ আসাদন

জ্যোতির্বিজ্ঞান পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি। অনেক বিজ্ঞানীদের মতে এটিই সবচেয়ে প্রাচীনতম বিজ্ঞান। আর এমনটি ভাবা মোটেও অবাক হওয়ার কিছুনা। বরং যদি এমনটি না ভাবা হয়, তাহলে হয়তো অনেক অবাক হওয়াই উচিত। কেননা মানুষের ভাষা ও বোধগম্যতা বহিঃপ্রকাশ হওয়ারও বহু আগে, এমনকি মানুষের সভ্যতার বিকাশ হওয়া যে আগুন আবিষ্কারের ফলে, তার থেকেও বহু আগে যে প্রাকৃতিক বিষয়টি মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিলো, যে বিষয়টি ভাবিয়েছিলো; মন খারাপের বিষয়টা বুঝার আগেই যেই মন খারাপ হওয়ার কারণে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকতো মানুষ, কিংবা ঝলমলে মিটিমিটি তারা বা আলোকিত চাঁদ দেখার প্রয়াসে মানুষের মনে যে জিজ্ঞাসা তৈরি করতো, সূর্যের বিভিন্ন অবস্থান ও রাত দিনের পার্থক্য মানুষের মাঝে দিয়েছিলো কখনো প্রশান্তি আবার ভীতিকর অনুভূতি; সেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নামই তো জ্যোতির্বিজ্ঞান।

বিজ্ঞানের জন্ম-ইতিহাস নিয়েও আছে নানা বিতর্ক। জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তেমনি ছিল সমাজ, ধর্ম ও বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন রকম প্রভাব। জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দটি মূলত Astronomy শব্দের একটি পারিভাষিক শব্দ। শুরুতেই যদি এর শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে জানা যায়, তাহলে এর সম্পর্কেও স্পষ্ট ও সাবলিল ধারণা নেয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে। প্রাচীন কালে গ্রীক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা যখন আকাশের নক্ষত্র নিয়ে অনেক চিন্তা চেতনা প্রকাশ করেন, সেই থেকেই এই বিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটে। আর গ্রীক ভাষায় নক্ষত্র কে Aster বলা হতো, পরে ভাষার বিবর্তেন ফলে হয়ে যায় Astron, যার আধুনিক ইংরেজি শব্দ Star। একইভাবে Nomos শব্দ থেকে Nomia, এর অর্থ Law বা আইন বা প্রকৃতি। সেখান থেকে গ্রীক শব্দ Astronomia হয়ে আধুনিক ইংরেজি শব্দে Astronomy, যার অর্থ “The study or law or culture of stars”, অর্থাৎ “নক্ষত্রের প্রকৃতি চর্চা বা বিজ্ঞান”।
প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান মূলত ধর্মীয়শাস্ত্র, সংস্কৃতি ও জ্যোতিষশাস্ত্র দ্বারা প্রভাবিত ছিল। পরবর্তীতে 1750 থেকে 1800 সালের মাঝামাঝি সময়ে জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান পৃথক করা হয়। প্রাচীনকালে জ্যোতির্বিজ্ঞান বলতে মূলত খালি চোখে দৃশ্যমান সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ বুঝাতো। এর অনন্য প্রমাণ হলো বর্ষপঞ্জিকা। 46 খৃস্টপূর্বে জুলিয়াস সিজার প্রথম অধিবর্ষ যোগ করে বর্ষপঞ্জিকা সংস্করণ করেছিলেন। মূলত আকাশের বিভিন্ন অংশে সূর্যের অবস্থানের পরিবর্তন এবং নক্ষত্রসমূহের আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে যেয়েই বর্ষ গণনা পদ্ধতির আবির্ভাব হয়। প্রাচীন বিজ্ঞানীরা নক্ষত্র এবং গ্রহের মধ্যে পার্থক্য করতে পারতেন। কেননা নক্ষত্রসমূহ প্রায় শতাব্দিকাল একই অবস্থানে থাকলেও গ্রহসমূহ বেশ কম সময়ের মধ্যেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে। ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের সাথে সাথে একটি বিজ্ঞান চর্চা কিভাবে প্রায় শুন্য থেকে উঠে এসে, কোন কোন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের, কোন কোন উল্লেখযোগ্য অবদানের ফলে আজকের আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে পরিণত হলো? সেই ইতিহাসের একটি সুবর্ণ পাতায় আলোকপাত করাই আজকের আয়োজন।
প্রাচীন সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যারিস্টার্কাস (310-230 BC)
প্রথম দাবী করেন পৃথিবী নয় বরং সূর্যই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে রয়েছে এবং পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চার পাশে আবর্তিত হচ্ছে। অ্যারিস্টার্কাসকেই প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। শধু তাই নয়, প্রাচীন গ্রীকের কোপার্নিকাস বলেও খ্যাত অ্যারিস্টার্কাস অব সামোস।

গ্রীক জ্যোতির্বিদ ইরাতোসথেনেস (276-194 BC)
যখন বেশিরভাগ লোকেরা বিশ্বাস করতো যে পৃথিবী সমতল, তখন বিখ্যাত গ্রীক গণিতবিদ, ভূগোলবিদ ও জ্যোতির্বিদ ইরাতোসথেনেস (276-194 BC) গোলাকার পৃথিবীর আকার পরিমাপ প্রমাণ করতে সূর্যকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি পরিমাপ করেছিলেন, গোলাকার পৃথিবীর পরিধি 24,660 মাইল (39,690 কি.মি.); তাঁর পরিমাপটি সঠিক পরিমাপ থেকে 211 মাইল (340 কি.মি.) দূরে ছিল।

প্রাচীন গ্রীক জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ ক্লাডিয়াস টলেমি (AD 100-170)
সৌরজগতের একটি মডেল স্থাপন করেছিলেন। যেখানে সূর্য, নক্ষত্র এবং অন্যান্য গ্রহ পৃথিবীর চার দিকে আবর্তিত হয়। টলেমাইক সিস্টেম হিসেবে খ্যাত এই মডেলটি কয়েকশ বছর ধরে স্থায়ী ছিল। যদিও এটি ফ্ল্যাট বা সমতল মডেল হিসেবে ভুল প্রমাণিত হয়।

পশ্চিমা বিশ্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনা ঘটে মেসোপটেমিয়ায়। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল সুমের, অ্যাসিরিয়া এবং ব্যাবিলনীয়োর মতো সুপ্রাচীন সভ্যতা। সুমেরীয়রা খুব মৌলিক কিছু জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক কাজ করেছিল, যা ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে। ব্যাবিলনীয়রাই প্রথম ষাটভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেন, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ভারতীয় গণিতবীদ ও জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট (476-550 AD)
সঠিকভাবে জোর দিয়েছিলেন যে পৃথিবী প্রতিদিন এর নিজ অক্ষের চারদিকে ঘোরে এবং নক্ষত্রসমূহের আপাত গতিপথ পৃথিবীর আবর্তনের ফলে ঘটে যাওয়া একটি আপেক্ষিক গতি। তিনি তাঁর সময়ে সবচেয়ে নিখুতভাবে পৃথিবীর পরিধি 39,968 কি.মি. পরিমাপ করেছিলেন (ভুল মাত্র 0.2%)। সৌরজগতে গ্রহসমূহের কক্ষপথের আকৃতি উপবৃত্তাকার এবং একবছর সময়কাল নির্ণয় ছাড়াও সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের বৈজ্ঞানিক কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে তিনি সৌরজগতের মডেলটিকে সূর্যকেন্দ্রিক নাকি পৃথিবীকেন্দ্রিক ধরে চিন্তাকরেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। B.L. van der Waerden, Hugh Thurston এর লেখায় আর্যভট্টের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত হিসাব নিকাশের পদ্ধতিকে সরাসরি সূর্যকেন্দ্রিক বলে দাবি করেছেন। Noel Swerdlow অবশ্য বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে আর্যভট্টের ধারণায় সৌরজগত পৃথিবীকেন্দ্রিকই ছিল। অপর দিকে Dennis Duke এর মতে, আর্যভট্টের কাজের পদ্ধতি সূর্যকেন্দ্রিক ছিল, তবে সেটি আর্যভট্ট লক্ষ করেননি কিংবা জানতেন না।

পার্সিয়ান জ্যোতির্বিদ আবদ-আল-রহমান-আল-সুফি (903-986)
পশ্চিমাদের কাছে আজোফি হিসেবে পরিচিত, তিনি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাহিরে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির একদল নক্ষত্রপুঞ্জ প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এছাড়াও তিনিই প্রথম Large Magellanic Cloud (মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির স্যাটেলাইট হিসেবে পরিচিত, যা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ৩য় নিকটবর্তী গ্যালাক্সি) পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার করেছিলেন।

জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস (14730-1543)
১৬’শ শতাব্দীর পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস (14730-1543) সৌরজগতের একটি মডেল প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। মডেলটি পুরোপুরি সঠিক ছিল না। কারণ সেই সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মঙ্গল আর পৃথিবী গ্রহের কক্ষপথের মাঝে দ্বন্দ্বে পড়তেন। তবে অবশেষে এই মডেল অনেক বিজ্ঞানীর সৌরজগত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছিল।

জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে (1546-1601) ও ইয়োহানেস কেপলার (1571-1630)
ড্যানিস জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে (1546-1601) ও তাঁর সহযোগী জার্মান ইয়োহানেস কেপলার (1571-1630) নির্ধারণ করেছিলেন যে, গ্রহগুলি বৃত্তাকার পথে নয়, উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারদিকে ভ্রমণ করে। কেপলার গ্রহগুলির গতির সাথে জড়িত তিনটি সূত্র গণনা করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান মেরিনোর হান্টিংটন লাইব্রেরীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইতিহাসের কিউরেটর ড্যান লুইস বলেছেন, “কেপলার যে যুগে বাস করতেন, সেই যুগটি ছিল উত্থান ও পরিবর্তনের”। পৃথিবী কেন্দ্রিক মডেলটির বিরুদ্ধে চলতে থাকা উপবৃত্তাকার কক্ষপথ এবং আকাশের অন্যান্য ঘটনায় ভরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বক্তব্য ও তাঁদের বিশ্বাস কে হুমকির মুখে ফেলেছিল। ফলস্বরূপ, কেপলার এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী বারবারা একটি কোড তৈরি করেছিলেন যেনো গোপনে চিঠি আদান-প্রদান করে যোগাযোগ করতে পারেন, অত্যাচারের ঝুঁকিতে না পড়ার জন্য।

জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি (1564-1642)
ইতালীয় পদার্থবিদ, গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি (1564-1642) কে প্রায়শই অপটিক্যাল টেলিস্কোপ তৈরির জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। যদিও সত্যই তিনি তৎকালীন বিদ্যমান টেলিস্কোপ মডেল গুলির উন্নতি করেছিলেন। রাইস ইউনিভার্সিটির গ্যালিলিও প্রজেক্ট অনুসারে, “গ্যালিলিও ইউরোপের অন্যান্য উৎপাদিত টেলিস্কোপগুলির মডেলিং করে 1609 সালে প্রথম টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন, যা বস্তুকে 3 গুণ বড় করে তুলতে পারে। একই বছরের পরের দিকে একটি টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন, যা বস্তুকে 20 গুণ বড় করে তুলতে পারে”। তিনি আকাশের দিকে নতুন পর্যবেক্ষণ যন্ত্রটি ঘুরিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বৃহস্পতির চারটি প্রাথমিক চাঁদ (যা গ্যালিলিয়ান চাঁদ হিসেবে পরিচিত) এবং শনির বলয় আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি চাঁদের কলঙ্কের কারণ ও সৌরকলঙ্কের আবিষ্কার এবং কৃত্তিকা মণ্ডলের 36টি নক্ষত্র ও সে সময়ের রহস্যময় গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিছু বিষমতারা এবং কয়েকটি নীহারিকাও আবিষ্কার করেছিলেন। এজন্যই এই জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিদ কে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

জ্যোতির্বিদ জিওভান্নি ডোমেনিকো ক্যাসিনি (1625-1712)
আরেক ইতালীয় প্রকৌশলী ও জ্যোতির্বিদ জিওভান্নি ডোমেনিকো ক্যাসিনি (1625-1712) পরিমাপ করেছিলেন বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহ ঘুরতে কত সময় লাগে। তিনি শনির চারটি চাঁদ ও গ্রহটির বলয়গুলোর মধ্যে ফাঁক আবিষ্কার করেছিলেন, যা তাঁর নামানুসারে ক্যাসিনি বিভাগ অঞ্চল (নাসা শনি ও এর চাঁদ কে প্রদক্ষিণ করার জন্য একটি স্যাটেলাইট চালু করার সময় এই কৃতিত্ব তাঁকে প্রদান করেছিল) নামে পরিচিত। এছাড়াও তিনি “আয়া পেটাস” নামক একটি উপগ্রহের অদৃশ্য অঞ্চল আবিষ্কার করেন, যা “ক্যাসিনি রেজিও” নামে পরিচিত।

জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস (1629-1695)
ডাচ পদার্থবিদ, গণিতবিদ, কালপরিমাপবিদ্যাবিদ ও জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস (1629-1695) 1659 সালে প্রথম গ্রহের পৃষ্ঠভূমির বৈশিষ্ট্য, মঙ্গলগ্রহের আগ্নেয় জলাভূমি সিরিটিস মেজর পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁর মঙ্গলগ্রহের দিনের দৈর্ঘ নির্ণেয় তৎকালীন সবচেয়ে নিখুঁত ছিল। 1695 সালে মৃত্যুর অল্প সময় আগে হাইগেনস কসমোথেরোস সমাপ্ত করেন, যা মরণোত্তরভাবে 1698 সালে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে তিনি অন্যান্য গ্রহের উপর বহির্মুখী জীবনের অস্তিত্ব (এলিয়েন) সম্পর্কে অনুমান করেছিলেন, যা তিনি পৃথিবীর মতো করে কল্পনা করেছিলেন। এই ধরনের জল্পনা কল্পনা তখনকার সময়ে অস্বাভাবিক ছিল না, কোপার্নিকানিজম বা বহুগুন নীতি দ্বারা ন্যায্য ছিল। এছাড়াও তাঁর প্রস্তাবিত আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কয়েকশবছর ধরে বিস্মিত করেছিল যা শনির বলয়গুলির পর্যবেক্ষণ এবং এর চাঁদ টাইটান আবিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয়েছিল।

পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিদ স্যার আইজ্যাক নিউটন (1643-1727)
ইংরেজ গণিতবিদ, পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিদ স্যার আইজ্যাক নিউটন (1643-1727) বল, গতি ও জড়তার সূত্রের জন্য, বিশেষত মধ্যাকর্ষণ বলের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। যেসব বিজ্ঞানীরা তাঁর পূর্বে চলে গিয়েছিলো তাঁদের কাজের উপর ভিত্তি করে তিনি একটি উদ্ধৃতি করেন, “If I have seen further, it is by standing upon the shoulders of giants” । এখানে বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর পূর্বের বিজ্ঞানিদের অবদানের উপর ভিত্তি করে তাঁর কাজ ও আবিষ্কার প্রতিষ্ঠিত বলে মন্তব্য করেছিলেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি (1656-1742)
আরেক ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি (1656-1742) ঐতিহাসিক ধূমকেতু দর্শন পর্যালোচনা করেছিলেন এবং প্রস্তাব করেছিলেন যে 1456, 1531, 1607 এবং 1628 সালে যে ধুমকেতুগুলি দেখাগিয়েছিল সেসব একইরকম ছিল এবং 1758 সালে ফিরে আসবে। যদিও ফিরে আসার আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন, তিনি সঠিক প্রমাণিত ছিলেন। ধূমকেতুটির নাম রাখা হয়েছিল তাঁর সম্মানে। অক্সফোর্ড ত্যাগের পর 1676 সালে হ্যালি দক্ষিণ আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে যান এবং দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে তারা পর্যবেক্ষণ করে তারাগুলোর ক্যাটালগ তৈরির উদ্দেশ্যে সেখানে সেক্সট্যান্ট ও টেলিস্কোপ যন্ত্রসমেত একটি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করেন। 1678 সালের নভেম্বরে লন্ডনে ফিরে আসেন। পরের বছর রয়েল সোসাইটির পক্ষ থেকে পোল্যান্ডের Gdańsk শহরে যান। উদ্দেশ্য ছিল একটি বিতর্কের মীমাংসায় সাহায্য করা। টেলিস্কোপ ব্যবহার না করার কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানী Johannes Hevelius এর পর্যবেক্ষণগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন রবার্ট হুক । হ্যালি Hevelius এর সাথে থেকে আবার পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার পর্যবেক্ষণগুলো প্রমাণ করেন। একই বছর তিনি Catalogus Stellarum Australium নামক তারা তালিকাটি প্রকাশ করেন যাতে 341টি দক্ষিণাঞ্চলীয় তারার বিস্তারিত তথ্য ছিল। বর্তমানের তারা তালিকার সাথে তার করা তারা তালিকার তুলনা করে তাকে টাইকো ব্রাহের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

ফরাসী জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ের (1730-1817)
ফরাসী জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ের (1730-1817) নীহারিকা নামে পরিচিত বস্তুর ডাটাবেস রচনা করেছিলেন। এতে তাঁর চূড়ান্ত প্রকাশনায় 103 টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল, যদিও তাঁর ব্যক্তিগত নোটের অনেক অবজেক্টগুলি প্রায়শই ঐগুলির ক্যাটালগ নাম হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। যেমন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, এম-31 হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর ক্যাটালগ মেসিয়ের ক্যাটালগ হিসেবে পরিচিত, যা সংক্ষেপে এম-ক্যাটালগ। এছাড়াও তিনি তাঁর জীবদ্দশয়ায় 13টি ধূমকেতু আবিষ্কার করেছিলেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফেডরিক উইলিয়াম হার্শেল (1738-1822) ও তাঁর বোন ক্যারোলিন হার্শেল (1750-1848)
জার্মানে আবির্ভূত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফেডরিক উইলিয়াম হার্শেল (1738-1822) আকাশে 2,500টিরও বেশি বস্তু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি ইউরেনাস এবং এর দু’টি উজ্জ্বল চাঁদ, শনির দু’টি চাঁদ এবং মার্টিয়ান আইস ক্যাপগুলিও আবিষ্কার করেছিলেন। উইলিয়াম তাঁর বোন ক্যারোলিন হার্শেল (1750-1848) কে জ্যোতির্বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং ক্যারোলিন প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন ও কয়েকটি ধূমকেতু সনাক্ত করেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরিটা সোয়ান লেভিট (1868-1921)
হার্ভার্ড কলেজের একজন ‘মানব কম্পিউটার’ হিসেবে কর্মরত আমেরিকান মহিলা জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরিটা সোয়ান লেভিট (1868-1921), যিনি ফটোগ্রাফিক প্লেটে ভেরিয়েবল স্টার বা চলমান বা পরিবর্তনশীল নক্ষত্রের চিত্র চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে কেফেইড ভেরিয়েবল হিসেবে পরিচিত একটি বিশেষ কালকানি নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা প্রায়শই এটির স্পন্দনের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ সম্পর্কটি জ্যোতির্বিদদেরকে নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির দূরত্ব, মিল্কিওয়ের আকার এবং মহাবিশ্বের বিস্তারের পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করেছিল।

আলবার্ট আইনস্টাইন (1879-1955)
বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন (1879-1955) বর্তমান বোধগম্যের বাইরে চলে যাওয়া মহাবিশ্বের দিকে তাকানোর নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব দেওয়ার পরে এখন পর্যন্ত অন্যতম বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে আছেন। তিনি পরামর্শ দিলেন যে সমস্ত মহাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের বিধি একই। মহাশুন্যে আলোর গতি অবিচ্ছিন্ন এবং স্থান ও সময় মহাকাশ-কাল হিসেবে পরিচিত একটি সত্ত্বার সাথে যুক্ত, যা মধ্যাকর্ষণ দ্বারা বিকৃত হয়। 1966 সালে প্রদত্ত বক্তৃতায় সহবিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনেহাইমার বলেছিলেন, “আইনস্টাইন ছিলেন একজন পদার্থবিদ, একজন প্রাকৃতিক দার্শনিক, আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড়”।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল (1899-1953)
আইনস্টাইন মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার সাথে সাথে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল (1899-1953) গণনা করেছিলেন যে আকাশে ছোট ছোট ফোঁটা ফোঁটা ছোপ আকাশগঙ্গার বাইরে রয়েছে। তাঁর পর্যবেক্ষণের আগে, মহাবিশ্বের আকার নিয়ে আলোচনাটি শুধুমাত্র একটি ছায়াপথ নিয়ে ছিল। কিন্তু তিনি বিভিন্ন ছায়াপথের অস্তিত্ব আছে এবং সেগুলো বিভক্ত প্রমাণ করেছিলেন। হাবল নির্ধারণ করে বলেছিলেন যে, মহাবিশ্ব নিজেই প্রসারিত হচ্ছে। এটি এমন একটি পর্যবেক্ষণ যা পরে হাবলের আইন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। বিভিন্ন ছায়াপথগুলিতে হাবলের পর্যবেক্ষণ একটি আদর্শ মানদণ্ড করার অনুমতি দেয়, যা আজও ব্যবহৃত হয়।

জ্যোতির্বিদ হারলো শাপলে (1885-1972)
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ হারলো শাপলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আকার এবং এর কেন্দ্রের সাধারণ অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নীহারিকা নামে পরিচিত বস্তুগুলি গ্যালাক্সির বাইরে না গিয়ে এর চেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে এবং হাবলের পর্যবেক্ষণ গুলির সাথে ভুলভাবে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন যে, মহাবিশ্ব আকাশগঙ্গা ছাড়া অন্য ছায়াপথগুলিকে বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রেখেছে।

জ্যোতির্বিদ ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক (1930)
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক (1930) বহির্মুখী বুদ্ধি বা এলিয়েন অনুসন্ধানের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি অনুসন্ধানের জন্য বহির্মুখী গোয়েন্দা সংস্থা (SETI) এর অন্যতম ছিলেন এবং তিনি “ড্রেক সমীকরণ” তৈরি করেছিলেন, এটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে বহিরাগত সভ্যতার সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য গণিতের একটি সমীকরণ।

জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান (1934-1996)
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান (1934-1996) এই তালিকার কারও তুলনায় কোনও বড় বিজ্ঞানী হতে না পারলেও, তিনি অন্যতম বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। তিনি কেবল গ্রহ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অধ্যায়নই করেননি, তিনি অন্যদের চেয়েও বেশি জ্যোতির্বিদ্যাকে জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন। তাঁর অসাধারণ শিক্ষা ও সীমাহীন শক্তি বিশ্বেজুড়ে মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। কারণ তিনি জটিল বিষয়গুলি এমনভাবে ভেঙে বুঝিয়ে দিতেন যে, আগ্রহী টেলিভিশন দর্শকদেরও তিনি জ্যোতির্বিদ্যায় শিক্ষিত করেছিলেন। তিনি মহাকাশ বিজ্ঞান ও অনুসন্ধানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিবেদিত একটি লাভজনক সংস্থাকে প্ল্যানেটারি সোসাইটিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম কে. হার্টম্যান (1939)
আমেরিকান জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম কে. হার্টম্যান 1975 সালে চাঁদ গঠনের বিষয়ে সর্বাধিক গৃহীত তত্ত্বটি পেশ করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, একটি বৃহৎ দেহের স্কুপডের সাথে সংঘর্ষের পরে, পৃথিবী থেকে ধ্বংস বিশেষ চাঁদে একত্রিত হয়েছিল।

বিশ্বতত্ত্ববিদ স্টিফেন হকিং (1942-2018)
ইংরেজ তাত্ত্বিকপদার্থবিদ ও বিশ্বতত্ত্ববিদ স্টিফেন হকিং (1942-2018) কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্বের ক্ষেত্রে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মহাবিশ্বের যেমন একটি সূচনা রয়েছে, তেমনি এর শেষও থাকবে। তিনি মহাবিশ্বের কোনও সীমানা নেই বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের পর থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল মনের একজন হিসেবে দেখা হলেও, হকিং এর অনেকগুলো বই এবং বক্তৃতাগুলি সাধারণ মানুষের দিকে এগিয়ে চলেছে। কারণ তিনি লোকেরা যে মহাবিশ্বে বসবাস করছেন সে সম্পর্কে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

বিশ্বের প্রথম বিশ্বতত্ত্ববিদ জামাল নজরুল ইসলাম (1939-2013)
বিজ্ঞানী হিসেবে যে কয়েকজন ব্যক্তি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদের মাঝে অন্যতম জামাল নজরুল ইসলাম (1939-2013)। তিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ। তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। সামগ্রিক মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে তিনি করেছেন বিশ্বমানের গবেষণা, যার জন্য অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি যখন মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তখন খুব বেশি কেউ এই ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেনি। জামাল নজরুল ইসলাম মহাবিশ্বের উচ্চমার্গীয় বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করেছিলেন তাঁর সহপাঠী স্টিফেন হকিং এর অনেক আগে। স্টিফেন হকিং এর প্রথম বই A Brief History of Time প্রকাশিত হয় 1988 সালে। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম এর প্রথম বই The Ultimate Fate of The Universe ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে 1983 সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি তাঁকে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা এনে দিলেও আমাদের দেশের মানুষেরা তাঁকে ঐভাবে চেনে না বললেই চলে।

একটা কথা প্রচলিত আছে, আদিকাল থেকে বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতটা এগিয়েছে; শুধু বিংশ শতাব্দীতে এগিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। কথাটির সত্যতা জ্যোতির্বিজ্ঞানেও পুরোপুরি প্রতিফলিত। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুভূতি ও ধর্মীয়শাস্ত্র, বিভিন্ন রূপকথার গল্প ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনা মানুষকে অন্ধকারের আবরণে ঢেকে রাখতো। যার দরুণ, আদৌত সত্য জ্ঞান সম্পর্কে তারা ছিল অজ্ঞ। ঠিক একইভাবে, যুগেযুগে মহাজ্ঞানী, গুণী ও ভিন্নচিন্তা ধারার মানুষের জন্ম হয়েছিল বলেই প্রাচীনকাল থেকেই জ্ঞান চর্চা থেমে থাকেনি।
লিখেছেনঃ মোহাম্মদ রুবেল দেওয়ান
ছদ্মনামঃ রাহ্সান
তথ্যসূত্রঃ
১/ The Five Ages of The Universe – Fred Adams & Greg Laughlin
২/ The Story of Astronomy – Jefferson Weaver and Lloyd Motz
৩/ Wikipedia