নারী দিবসঃ আগামীর অগ্রদূতদের সংবর্ধনা দিবস

 নারী দিবসঃ আগামীর অগ্রদূতদের সংবর্ধনা দিবস

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস, সারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় এই দিনটি মহাসমারোহে পালন করা হয়। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা, ভালোবাসা প্রকাশ করে এই দিনটিকে পালন করা হয়। ১৯০৯ সালে প্রথম পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ঐ বছরেই প্রথম ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় নারী দিবস পালন করা হয়।

ইতিহাস

১৮৫৭ সালের ৮ ই মার্চ নারীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি সূচ তৈরির কারখানার নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। কারখানার মানবেতর পরিবেশ, ১২ঘন্টার কর্ম সময়, অপর্যাপ্ত বেতন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে তাদের এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিন্তু, পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলে মহিলা শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালায়। বহু শ্রমিককে আটক করা হয়। এই ঘটনার স্মরণে ১৮৬০ সালের ৮ ই মার্চ মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে নিউইয়র্ক সূচ শ্রমিকগণ। এভাবেই সংঘবদ্ধ হতে থাকে নারী শ্রমিকদের আন্দোলন। এক সময় তা কারখানা ও ইউনিয়নের গন্ডি অতিক্রম করে পৌঁছে যায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতন্ত্রী নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে।
১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়েছিল। নারীদের কাজের অধিকার, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কাজের বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রতিবাদ করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। একই সঙ্গে রাশিয়ান মহিলারাও প্রথমবার ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। ইউরোপের নারীরা ৮ ই মার্চ শান্তি কার্যক্রমকে সমর্থন করে বিশাল মিছিলে নামেন। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ ই মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রাষ্ট্রে নারী অধিকার ও বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য, শুধুমাত্র ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে ৮ ই মার্চে পালন করা হয়।

বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪৯ ভাগ অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেক নারী। নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ না থাকলে, দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। আবার একই রকম সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে না পারলে, দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয়না। বেগম রোকেয়া থেকে বেগম সুফিয়া কামাল পর্যন্ত যে সময় অতিবাহিত হয়েছে, সে সময়ে তাঁরা যে বাংলার নারীর স্বীয় মর্যাদা, অধিকার, নারীমুক্তির অবিচ্ছেদ্য সংগ্রামে তা আজ আমাদের কাছে নারীমুক্তি আন্দোলনের উদাহরণ ও অনুপ্রেরণা। কিন্তু দুঃখজনক যে আজও আমাদের দেশের নারীরা পুরুষশাসিত -সমাজের কাছে অবহেলিত। এদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে গোঁড়ামি,ধর্মীয় ফতোয়া প্রবল। ফলে নারী অধিকার লঙ্ঘিত হয় সবচেয়ে বেশি।
নারীর সমঅধিকার ও নারীমুক্তির কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে, কিন্তু নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি। আজও অসংখ্য নারী এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে। গৃহপরিচারিকার উপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। এমন একটি দিনও নেই যেদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতনের দু একটি মর্মান্তিক ঘটনা না ছাপা হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নারীসমাজের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। যেমন গার্মেন্টস শিল্পে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক কাজ করছে। আবার পরীক্ষার মেধাতালিকায়ও মেয়েদেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তারপরও সমাজে নারীদের প্রতি কেমন একটা অবহেলার দৃষ্টি!


নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধাগুলো হলো

  • প্রথম ও প্রধান বাঁধা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।
  • সামাজিক কুসংস্কার নারী উন্নয়নের পথে এক বড় অন্তরায়।
  • নারী শিক্ষার অভাব হলে আয় বাড়ে না, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
  • নারীর ক্ষমতায়ন না থাকা।
  • নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা।
  • কৃষিভিত্তিক সমাজ।

নারীর উন্নয়নে করণীয়

নারীর উন্নয়ন বলতে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কাজের যথাযথ মূল্যায়নকে বুঝানো হয়। নারী উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। এজন্য করণীয় হলঃ

  • নারীর প্রধান শক্তি হল শিক্ষা। নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটলে নারীর কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। তাই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নারী শিক্ষার বিস্তার।
  • নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব।
  • নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা।
  • নারীর নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
  • রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন করা।
  • নারী স্বার্থের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
  • নারীর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়ক সেবা প্রদান করা।

“কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ী লক্ষ্মী নারী
 ”

”পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’

– কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।


এই নারীর অবদান পুরুষ কখনোই অস্বীকার করতে পারবে না। পুরুষের প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে নারীর ভূমিকা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী পুরুষ সমতার লক্ষ্য অর্জনের পথে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পশ্চাৎপদতার অমানিশা কেটে পরিপূর্ণ আলোর পথে এগিয়ে যাক সোনার বাংলা-এটাই হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রত্যাশা।

লিখেছেনঃ শারমিন মনিকা

ফিচার ইমেজ ক্রিয়েটেড বাইঃ হাসিন মাহতাব

© All rights reserved by RED LIVE

RedLive

Related post