বাংলার প্রাচীন মসলিন ঐতিহ্য

 বাংলার প্রাচীন মসলিন ঐতিহ্য

Image Source: pexels

অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের কুটির শিল্প  অর্জন করেছিল বিশ্ব মর্যাদা। বাঙালি শিল্পীদের হাতে তৈরি মসলিন তার প্রমাণ দেয়। বাংলার পল্লীর মানুষ তাদের নিপুণ হাতে তৈরি করতেন এমন অসাধারণ সকল পণ্য।তাই তো কবিদের কবিতায় ফুটে উঠেছে বাংলার মসলিনের কথা,

বাংলার মসলিন

বোগদাদ রোম চীন কাঞ্চন-তেলেই

কিনতেন একদিন !

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ঘরে বসে হাতে তৈরি সকল দ্রব্যসামগ্রীই কুটিরশিল্প। কুটিরশিল্পের অনেকগুলো শাখা রয়েছে। তাঁত শিল্প, রেশম শিল্প, স্বর্ণশিল্প, সূঁচ শিল্প, সিমেন্ট শিল্প, পাট শিল্প, রন্ধনশিল্প ইত্যাদি। এই সকল শিল্পের জন্য নানা শ্রেণীর লোক কাজ করে থাকেন, যেমন: কামার, কুমার, তাঁতি, কাঁসারি ইত্যাদি।

তাই যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের কুটির শিল্প দেশ ও মানুষের মন জয় করে আসছে। ঢাকার জামদানী, রাজশাহী সিল্ক, মুর্শিদাবাদের শিল্পীদের হাতির দাঁতের উপর শিল্পকর্ম, মালদহ ও কাঞ্চন নগরের দা,বটি, বর্ধমানের বনপাশের বন্দুক, যশোরের চিরুনি ইত্যাদির বেশ খ্যাতি ছিল।

কুটির শিল্প সামগ্রীকে শিল্পীরা সহজেই বিভিন্ন আকৃতিতে রুপদান করতে পারে। একসময় বাংলার ঐতিহ্য ছিল কুটির শিল্পের উপর নির্ভরশীল এবং অনেক মানুষ কুটির শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। রুপ ও বৈচিত্রের দিক দিয়ে বাংলার  কুটির শিল্প ছিল তুলনাহীন।

কিন্তু সেই গৌরবোজ্জল দিনগুলো আমরা হারাতে বসেছি। অষ্টাদশ শতক থেকে ইউরোপ বিপ্লবের কারনে উনিশ শতকের মধ্যভাগে কুটির শিল্পের উপর মারাত্মক ভাবে আঘাত হেনেছে। আমাদের দেশে যেটুকু এখনও টিকে আছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার অভাবে যেকোন সময় বিলুপ্ত হতে পারে।

বাংলাদেশে কুটির শিল্প অবনতির অনেকগুলো কারন রয়েছে। শিল্প বিপ্লবের যখন ইংরেজি বণিকরা জাহাজ ভর্তি সস্তা কাপড়, গ্লাসগো, লোহার তৈরি দ্রব্য সম্ভার এদেশে আগমন করলো, সেদিন থেকেই বাংলার কুটির শিল্পের পতন দেখা হয়।

অনেক কুটির শিল্পীরা বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয়। তাছাড়া বর্তমানে বড় বড় ব্যাংক চাকরি, মাল্টিন্যাশনাল চাকরির ভীড়ে কুটির শিল্পে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ঠিকমতো অর্থ সম্মান পাচ্ছেন না বলে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। স্বল্প মূল্যের বিদেশি পন্যের আড়ালে দেশীয় পন্য গুরুত্ব হারাচ্ছে ক্রেতারাও কম মূল্যের কারনে দেশীয় পন্যকে কম গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের কুটির শিল্প অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

কুটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সম্পদ। এই দেশে কুটির শিল্পের উন্নয়ন ব্যতিত সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। একসময় কুটির শিল্পের খ্যাতি বিশ্ব মাতিয়ে ছিল। চীনের সম্রাট, বাগদাদের খলিফা, রোমের শাসক বাংলার কুটির শিল্পের সমাদর ও করতেন।

এতে আমাদের শিল্প মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জীবিকা নির্বাহের উৎস হিসেবে কুটির শিল্পের গুরুত্ব অনেক। কুটির শিল্পের উন্নতি হলে বেকারত্ব অনায়াসে দূর করা সম্ভব হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির দুরবস্থা দূর হবে।

আমাদের দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকারে রুপ ধারণ করেছে। এই সমস্যা কিন্তু অনায়াসে দূর করা যায়। দেশের ৮৫ ভাগ মানুষ কুটির শিল্পের সাথে জড়িত। কুটির শিল্প বিদেশে রপ্তানি করা গেলে আমাদের দেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।

সার্বিক মঙ্গল বিবেচনা করে মৃতপ্রায় কুটির শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে মূলধন যোগান, সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহ সহ উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে, যেমন:

  • যথাসম্ভব সহজ শর্তে ঋন সুবিধা প্রদান করতে হবে।
  • দেশের প্রত্যেকটি গ্রামে সমবায় ভিত্তিতে কুটির শিল্প গড়ে তুলতে হবে।
  • কুটিরশিল্পীদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ন্যায্য মূল্যে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • আমাদের প্রস্তুতকৃত শিল্পের পন্য বিদেশ থেকে অবাধ আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

কুটির শিল্পের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করছে।বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ হলো কুটির শিল্প। কুটির শিল্পের মাধ্যমে বেকারত্ব অনায়াসে কমিয়ে আনা সম্ভব। রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। সবকিছু বিবেচনা করে কুটির শিল্পের প্রসার ও প্রচার প্রয়োজন।

লিখেছেনঃ খাতুন-ই জান্নাত বিবি ফাতেমা

RedLive

Related post