বাংলার স্বর্ণযুগের ঐতিহ্য বহনকারী মসলিনের সুখ-দুঃখের কথা

 বাংলার স্বর্ণযুগের ঐতিহ্য বহনকারী মসলিনের সুখ-দুঃখের কথা

সেকালে বাংলায় উৎপন্ন হত এক ধরণের মিহি কাপড়, নাম তার ‘মসলিন’। মসলিনের খ্যাতি ছিল গোটা বিশ্ব জুড়ে! কথিত আছে, মসলিনের শাড়ি নাকি অনায়াসে একটি আংটির ভেতর দিয়ে গলে যেতে পারত। সুদীর্ঘ ৫০ মিটারের মসলিনের শাড়ি ছোট্ট দিয়াশলাইয়ের বাক্সে স্থান পেয়ে যেত খুব সহজে – এমনই এক ঘোর লাগা বিস্ময়ের নাম ছিল মসলিন। আর আজ আমরা জানব বাংলার স্বর্ণযুগের ঐতিহ্য বহনকারী ‘মসলিন’ সম্পর্কে। শুনব মসলিনের সুখ-দুঃখের যত কথা।

মসলিন শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘মসুল’ থেকে। আর পাঁচটা কাপড়ের তুলনায় অনেকখানি আলাদা এই মসলিন কাপড়। কেননা অন্যান্য কাপড়ের চেয়ে মসলিন অনেক বেশি মিহি, অনেক বেশি সূক্ষ্ম। মূলত এই সূক্ষ্ম বুননের বৈশিষ্ট্যের কারণেই বিশ্বব্যাপী মসলিনের এত কদর। কিন্তু একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার; যতখানি সূক্ষ্ম মসলিনের কাপড়, ততখানি কঠিন এর বুননশৈলী!

ছবিঃ তাঁত শিল্পির হাতে বুনা মসলিন শাড়ির গল্প

বিখ্যাত মসলিন গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হত সাধারণত দেশের অভিজাত শ্রেণীর লোকেদের। কারণ রাজকীয় পোশাক বিনির্মাণে মসলিনের ছিল জুড়ি মেলা ভার। বুননশৈলী, নকশা কিংবা সূক্ষ্মতার বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে প্রচলিত ছিল বিভিন্ন ধরণের মসলিন। সবচেয়ে সেরা মানের ‘মলবুস খাস’ আর ‘মলমল খাস’ মসলিন জুটত সম্রাট আর নবাবদের ভাগ্যে। আরেক উঁচু দরের মসলিনের নাম ছিল ‘সরকার-ই-আলা’। কম সুতার সূক্ষ্ম মসলিন পরিচিত ছিল ‘ঝুনা’ হিসেবে।

ছবিঃ মসৃনতার, মলিনতার প্রতীক মসলিন

পানির মতো স্বচ্ছ এক ধরণের মসলিন খুব প্রচলিত ছিল, যার নাম ‘আব-ই-রওয়ান’। ঘন বুননের মসলিনকে বলা হত ‘খাসসা’। নকশাদার মসলিনের নাম ছিল ‘জামদানি’। ভোরের শিশিরের সাথে ‘শবনম’ নামক আরেক ধরণের মসলিনকে তুলনা করা হত। তাছাড়া কার্যভেদে প্রচলিত ছিল ‘বদন খাস’, ‘সর-বন্ধ’, ‘ডোরিয়া’, ‘রঙ্গ’, ‘আলিবালি’, ‘তরাদ্দাম’, ‘তনজেব’, ‘সরবুটি’, ‘চারকোনা’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের মসলিন। বাংলা নামের মসলিন ছিল একটাই, ‘নয়ন সুখ’। গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে ব্যবহৃত হত এই মসলিন।

ছবিঃ মসলিন শাড়িতে ঐতিহ্যের ফ্যাশনে বাঙালি নারি

ইংরেজ শাসনামল থেকে বাংলা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে তার স্বর্ণযুগের দিনগুলো। একইসাথে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী মসলিন। এখনকার জামদানিকে বলা যেতে পারে মসলিনের বহু দূরের এক শ্রেণি।

আসল মসলিনের বুননশৈলী অত্যন্ত শক্ত। বিভিন্ন প্রজাতির তুলার গাছ থেকে সুতা সংগ্রহ করে কাপড় বানিয়ে অনেকেই দাবি করতে পারে যে, তারা মসলিনের কাপড় বুনন করেছে! কিন্তু আসল মসলিনের কাপড় বুনতে চাই ‘ফুটি কার্পাস’ গাছ। বিশেষ এই তুলা গাছের দেখা পাওয়া যেতে পারে শুধু ভারত তথা বাংলাদেশে। এবং মসলিন বুননের উদ্দেশ্যে এই ‘ফুটি কার্পাস’ গাছ থেকে সংগৃহীত সুতা হতে হবে অত্যন্ত চিকন। তাছাড়া আরও অনেক ব্যাপার আছে; ২ গ্রাম ওজনের ১ হাজার মিটার দীর্ঘ অর্থাৎ ৫০০ কাউন্টের সুতা দিয়েই কেবল মসলিন কাপড়ের বুনন করা সম্ভব। ৫০০ কাউন্টের সুতা কাটাও আবার সহজ নয়। কেননা চরকা না হলে যে কাটাই যায় না ৫০০ কাউন্টের সুতা!

আজকালকার আধুনিক যুগে সুতা কাটার জন্য রয়েছে বিশেষায়িত যন্ত্র। চরকার ব্যবহার একরকম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে আমাদের স্বর্ণযুগের ঐতিহ্য। তবু অনেকখানি আশা নিয়ে হারিয়ে ফেলা মসলিনকে পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে গত ছয় বছর ধরে গবেষণার কাজে নিযুক্ত ছিলেন একদল গবেষক। ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ ছিল তাদের গবেষণা প্রকল্পের নাম। সম্প্রতি সফলতার আলো দেখতে শুরু করেছে তাদের এই মসলিন পুনরুদ্ধারের প্রকল্প। অবশেষে পুনর্জন্ম সম্ভব হয়েছে ঢাকা তথা বাংলাদেশের মসলিনের। আশা রাখি আবারও ফিরে আসবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিনের স্বর্ণযুগ।

লিখেছেন : নবনীতা প্রামানিক

RedLive

Related post