মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
বিটকয়েন আদ্যোপান্ত:বিটকয়েন কি!

বিটকয়েন! বর্তমান পৃথিবীতে একটি আলোচনার বিষয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে আপনি যখন এই লেখাটি পড়ছেন, তখন একটি বিটকয়েনের মূল্যমান বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪৯ লক্ষ টাকা।
প্রশ্ন হলো এই বিটকয়েন আসলে কি? এটি হলো একপ্রকার ডিজিটাল কারেন্সি বা মুদ্রা। সহজ ভাষায় বললে যে মুদ্রার কোনো শারীরিক অস্তিত্ব নেই। বিটকয়েনের অস্তিত্ব অনেক আগে থেকে থাকলেও এর ধারণা জনপ্রিয় হয়ে উঠে ২০০৯ সালে ‘সাতোশি নাকামোতো’ নামে একজন যখন ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে একটি পেপার জমা দেন। কিন্তু এই নামে কেউ এখনও পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করেনি। তাই বিটকয়েনের আবিষ্কর্তা কে এই নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। বিটকয়েনের এত জনপ্রিয়তার পিছনে এর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর অন্যতম কিছু বৈশিষ্ট্য হলো : বিটকয়েন অন্য কারেন্সি বা মুদ্রার মত কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। বিকেন্দ্রিভূত হওয়ার কারণে এর মাধ্যমে অতি সহজে অন্য দেশের সাথে লেনদেন করা যায়। এবং এতে মুদ্রা বিনিময়ের বা মানি এক্সচেঞ্জ এর মত ঝামেলা পোহাতে হয় না। এছাড়াও লেনদেনের সময় ব্যক্তির পরিচয়ও গোপন থাকে যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষণে সহায়ক। তাছাড়া বিটকয়েন একই সাথে মুদ্রা এবং স্টক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। হ্যাঁ, বিটকয়েন অনেকটা স্টক এর মতই উঠানামা করে এবং এটি স্থিতিশীল উঠানামা নয়। চাহিদা এবং যোগানের উপর ভিত্তি করে এই উঠানামাটি হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত বিটকয়েনের মূল্যমান প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত তা পরিবর্তন হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো বিটকয়েন কিভাবে পাওয়া যায়। বিটকয়েন পাওয়ার তিনটি উপায় আছে। প্রথমটি হলো আসল টাকার বিনিময়ে, দ্বিতীয়টি হলো কোনো জিনিস বা পণ্যের বিনিময়ে এবং তৃতীয় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় হলো বিটকয়েন মাইনিং এর মাধ্যমে। অর্থাৎ বিটকয়েন তৈরি করে। এই কাজটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত কিছু গাণিতিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তবে এই কাজটি অনেক শ্রম, সময় এবং অবশ্যই ব্যয়সাপেক্ষ।
বিটকয়েনের লেনদেনের হিসাবটি বিটকয়েনের একটি লিস্ট এ লেখা থাকে এবং বিটকয়েনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এই বিটকয়েনের এই লিস্টটি পাবলিক থাকা। একটি বিটকয়েনের লেনদেন হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে এই লিস্টটি সেই প্রায় ৪৭,০০০ নোড বা কম্পিউটার বা মাইনারের কাছে চলে যায়। আর এই লিস্টকেই বলা হয় ব্লকচেইন। ক্রিপ্টোকারেন্সি এর কারণেই মূলত ব্লকচেইন এর ধারণা বর্তমানে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেহেতু এই লেনদেন সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে হয় তাই বিশ্বস্ততা বজায় থাকে সকলের মধ্যে। বিটকয়েনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য হলো এর সংখ্যা কিন্তু নির্দিষ্ট। বলা হয় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন থাকতে পারবে। যার মধ্যে প্রায় ১৮.৫ মিলিয়ন বিটকয়েন ইতোমধ্যেই মাইনিং করা হয়ে গিয়েছে এবং ধারণা করা হয় ২১৪০ সালের মধ্যেই সমস্ত বিটকয়েন মাইন করা হয়ে যাবে। আর শুধু তাই নয় বিটকয়েনের প্রতি লেনদেনে সেই বিটকয়েনের মাইনাররা একটি অংশ পাবে।
তবে আসল কথা হলো এই জনপ্রিয় বিটকয়েন কি বাংলাদেশে বৈধ? উত্তর হলো, ‘ না ‘ । বাংলাদেশে এখনও বিটকয়েনকে বৈধতা দেয়নি। বিটকয়েনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর মাধ্যমে পরিচয় গোপন রেখে লেনদেন করা যায় এবং এটি চিন্তার কারণ সরকারের । কারণ বাংলাদেশের মতো উপমহাদেশীয় দেশ যেখানে অপরাধের হার অন্য উন্নত দেশের তুলনায় বেশি, সেখানে এই বিটকয়েনকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ কার্যে লেনদেন হতে পারে। আর এই কারণেই এখনও পর্যন্ত বিটকয়েনকে বাংলাদেশে বৈধতা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যাক্ট ১৯৪৭ এবং মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট ২০১২ অনুসারে বিটকয়েন বাংলাদেশে অবৈধ। বিটকয়েন অনেক দেশে অবৈধ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো বিটকয়েনের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের যে লেনদেন হয় তার জন্য কোনো ট্যাক্স নেই। সরকার এই লেনদেন থেকে একটি বড় অঙ্কের ট্যাক্স পেতে পারে। তাই যেসকল দেশ বিটকয়েনকে বৈধ করছে তারা এর উপর ট্যাক্স ও আরোপ করছে। তাই সরকারকে ফাঁকি দিয়ে অর্থ উপার্জন করা যাবে না। আশা করা যায় যেসকল দেশ আগে বিটকয়েনকে বৈধতা দেয়নি, তারাও আস্তে আস্তে ট্যাক্সেশন এর আওতায় এনে একে বৈধতা দিবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতই এর উদাহরণ। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এত দিন পর্যন্ত বিটকয়েন ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা রেখেছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়। যেখানে বিটকয়েন সহ সব ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈধতা দেয়। তবে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর ভূমিকা এক্ষেত্রে কি হবে, ট্যাক্সেশান এর বিষয় সহ আরো কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তাই এখনও ভারতে বিটকয়েনের লেনদেন সেভাবে বৈধতা পায়নি।
কিন্তু এত কথার মধ্যে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। বিটকয়েন কতটা নিরাপদ? ২০২০ সালের জুলাই মাসে ‘ফাইন্যান্স রিসার্চ লেটারস্’ নামে একটি জার্নাল দাবি করে যে বিটকয়েন আসলে তেমন নিরাপদ নয়। কিন্তু মানুষ কেন তাও এতে বিনিয়োগ করছে? কারণ বর্তমানে সাধারণ মানুষ ‘ ফিয়াট মানি ‘ বা ইকোনমিক সিস্টেম যেমন ব্যাংক, শেয়ার সিস্টেমে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। চলিত ইকোনমিক সিস্টেমে যেহেতু সব কিছু কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত, তাই যে কোনো মুহূর্তে মানুষ তার সম্পদ হারাবে এই ভয়টা থাকছে। তাই অনেক মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতেও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এর বিপরীতে যেখানে বিটকয়েনের লেনদেন সম্পূর্ন প্রকাশ্যে ঘটছে, মানুষের তাই এর উপর আস্থা তৈরি হচ্ছে। এর সাথে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা তো রয়েছেই। তবে বিটকয়েনের স্টক হিসেবে ব্যবহার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর এবং এতে কিছুটা ঝুঁকি অবশ্যই থাকে। ২০১৮ সালের জানু়য়ারী থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিটকয়েনের মূল্যমান প্রায় ৬৫% কমেছিল, যা অবশ্যই বিশাল ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়।
তবে এত ঝুঁকির মধ্যেও অনেক মানুষ বিটকয়েনে বিনিয়োগ করছে। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ২০১৪ সাল থেকেই বিটকয়েনকে সমর্থন করছেন। বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের বিটকয়েন কিনছে এবং তারা দাবি করছে ভবিষ্যতে টেসলা গাড়ি কেনা যাবে বিটকয়েন দ্বারা। আবার অন্যদিকে ওয়ারেন বাফেট বলেন বিটকয়েন হলো বাবল এর মতো। তার মতে এর কোনো মূল্যই নেই। এত বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের যেখানে বিটকয়েন নিয়ে ভিন্ন মত আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের তো নানা মত থাকবেই! তবে অদূর ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে বিটকয়েনকে বৈধতা দেওয়া হয়, আপনি এতে বিনিয়োগ করছেন তো?
লিখেছেনঃপূজা ধর