বিষণ্ণতা: কারণ ও করণীয়!

 বিষণ্ণতা: কারণ ও করণীয়!

“বিষাদগ্রস্ততার চাদরে বাড়ছে বিষণ্ণতা, মনে মনে তাই তো তরুণ ভাবছে আত্মহননের কথা।”

বর্তমান সময়ের মানসিক রোগ গুলোর মাঝে “বিষণ্ণতা” প্রথম সারিতে রয়েছে। ‘বিষণ্ণতা’ যেন এক নীরব ঘাতকের নাম।সমাজে এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা,যিনি মানসিক অবসাদে আক্রান্ত নন।আপাত ভাবে মন খারাপ হওয়াকে অনেকে বিষণ্ণতা বলে থাকেন।যে কোনো বয়সের মানুষ জীবনের যে কোনো সময়ে বিষণ্ণতায় পর্যবসিত হতে পারেন।তবে বর্তমান তরুণদের মাঝে বিষণ্ণতার প্রকোপ খুব বেড়ে গিয়েছে।বিষণ্ণতা একজন মানুষকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়।

মানসিক অবসাদগ্রস্ততা বেশি হলে একজন মানুষ পার্থিব সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেলেন।মানুষ তখন তার প্রাত্যহিক কাজকর্মে অনীহা প্রকাশ করে কর্মবিমুখী হয়ে যায়,এমতাবস্থায় উক্ত ব্যক্তিকে বিষাদগ্রস্ত বলা হয়।আর এই পরিস্থিতিকে বিষণ্ণতা বলে।ডিপ্রেশন,হতাশা,মানসিক অবসাদ এই শব্দ গুলোর সাথে বিষণ্ণতার মেলবন্ধন আছে।একজন মানুষ জীবনে বিষণ্ণতার কারণ হিসেবে:-পারিবারিক ,মানসিক ,সামাজিক,আর্থিক, এবং শারীরিক,এই বিষয় গুলো মুখ্য হলেও আরও নানাবিধ গৌণ কারণ রয়েছে।

পারিবারিক জিনগত কারণে একজন মানুষ বিষাদগ্রস্ত হতে পারেন।আবার পারিবারিক অনাদর,অস্বচ্ছলতা ইত্যাদি কারণেও একজন ব্যক্তি বিষাদগ্রস্ত হতে পারেন। কোনো ব্যক্তি যখন নিজেকে অযোগ্য-অকর্মণ্য মনে করেন,তখন তিনি মানসিক বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হন। সামাজিক বিভিন্ন রীতি,নীতি,প্রথা,আচার প্রভৃতিও কখনো কখনো কারো জন্য বিষণ্ণতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ব্যতীত একজন মানুষ জীবনের নানামুখী সুযোগ,সুবিধা,আরাম আয়েশ বিলাসিতা এই বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত হোন,ফলে নিজেকে নিয়ে বিষণ্ণতায় ভোগেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ বা অক্ষম অথবা যৌন সমস্যাতে আক্রান্ত ব্যক্তিও বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন থাকেন।এতে করে জীবনের স্বাদ,আহ্লাদ সবকিছু তার কাছে ম্লান হয়ে যায়।

এছাড়াও বিয়ের পর ডিভোর্স,প্রিয়জনের মৃত্যু,বেকারত্ব,চাকরী চলে যাওয়া,আশানুরূপ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল না পাওয়া,প্রেমঘটিত বিষয় গুলোও একজন মানুষকে বিষণ্ণতায় পর্যবসিত করতে যথেষ্ট!

যখন কোনো মানুষ মানসিক বিষণ্ণতায় ভোগেন তখন তার সহজাত প্রবৃত্তিতে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন:-

-খাওয়া দাওয়ায় রুচি কমে যায়। -পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম না হওয়া।

-কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলা।

-মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাওয়া।

-উৎফুল্ল বোধ না করা। -নতুন কাজ কর্মে অনীহা প্রকাশ করা।

-একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা।

-অন্ধকারে থাকাকে শ্রেয় মনে করা।

-অনেক মানুষের মাঝেও মন মরা হয়ে থাকা,একাকী বোধ করা।

-পরিবারের সদস্য,বন্ধু-বান্ধব কারো সাথেই মন খুলে কথা না বলা।

-কায়িক পরিশ্রমে অনীহা প্রকাশ করা।

-পার্থিব মায়া,মোহ থেকে নিজেকে দূরে রাখা।

-এবং আত্মহত্যার প্রবণতা পোষণ করা।

বিষণ্ণতার সর্বোচ্চ ধাপ হিসেবে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়।তাই আমাদের উচিৎ বিষাদগ্রস্ততায় আচ্ছন্ন ব্যক্তিকে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে ক্রমাগত প্রেরণা দেয়া। এলক্ষ্যে বিষণ্ণতা দূরীকরণে করণীয় হিসেবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে। যেমন:-

-বিষাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সবসময় অনুপ্রেরণা মূলক কথা বলে তাকে উজ্জীবিত রাখতে হবে।

-কায়িক পরিশ্রমে উৎসাহ দিতে হবে। -উক্ত ব্যক্তির পছন্দসই রান্না করে অনিয়মিত খাদ্যাভাসে রুচি ফিরিয়ে আনতে হবে।

-বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক বই পড়ার উপদেশ দিতে হবে।

-মোটিভেশনাল স্পিচ শোনাতে হবে। -উক্ত ব্যক্তির প্রতি সহমর্মিতাবোধ দেখাতে হবে।

-শুধুমাত্র উক্ত ব্যক্তির প্রতি Sympathy না দেখিয়ে Empathy’র সহিত তার অবস্থা বুঝতে হবে।

-উক্ত ব্যক্তির ফিলিংস,ইমোশন এইগুলি বুঝতে হবে।

-এ ধরণের ব্যক্তিদের আচরণে নানাবিধ পরিবর্তন আসে,তখন সহনশীল হতে হবে।

-বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের জন্য উৎসাহ দিতে হবে।যেমন: ছবি আঁকা,লেখালেখি করা,হস্তশিল্প,কারুশিল্প ইত্যাদি বুঝতে হবে।

-এ ধরণের ব্যক্তিদের আচরণে নানাবিধ পরিবর্তন আসে,তখন সহনশীল হতে হবে।

-নির্দিষ্ট সময়ের কাজগুলো করার তালিকা তৈরী করে দিতে হবে।

-প্রাণায়াম,যোগব্যায়াম,শরীর চর্চায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।

-গল্প,আড্ডা,গানে বিষণ্ণ ব্যক্তিকে মাতিয়ে রাখতে হবে।

-প্রতিটা কাজে তাকে পজিটিভ ফিডব্যাক দিতে হবে।

-তাকে কথা বলায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।তার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে।

-আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করা যেতে পারে।

-সবসময় তাকে প্রফুল্ল ও হাসিখুশি রাখতে হবে।

-ধর্মীয় বিধান অনুসারে চলার উপদেশ দিতে হবে।

-সামাজিক উন্নয়নমূলক তথা-বৃক্ষরোপন,বন্যার্তদের সাহায্য করা,রক্তদান,শীতবস্ত্র বিতরণ করা,পথশিশুদের পাঠদান,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান সহ বহুবিধ কাজে তাকে অংশীদার করা।

-সাংস্কৃতিক তথা গান,নাচ,কবিতা আবৃত্তি,নাটক সহ বিভিন্ন পারফর্মিং কাজে তাকে অংশীদার করা।

-পরিবারের সদস্যদের উচিৎ হবে সবসময় তার খেয়াল রাখা।

-জীবনের মানে,জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সম্যক অভিহিত করা।

-বিষণ্ণতার প্রকোপ মারাত্মক অর্থাৎ মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার,ডিসথেমিয়া,পোষ্টপারটাম ডিপ্রেশন,সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার,সাইকোটিক ডিপ্রেশন,বাইপোলার ডিপ্রেশন-এই টাইপ হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

মানুষের জীবনে প্রতিবন্ধকতা আসবেই।দমে বা থেমে গেলে চলবেনা।বরং নব উদ্যমে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে পুনরায় লালিত করতে হবে।স্বপ্নের জাল বুনতে হবে।তাহলেই একজন মানুষ নিজেকে আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে পারবে।আর মুক্তি পাবে “বিষণ্ণতা” নামক করালগ্রাস থেকে।

পরিশেষে বলতে চাই-

“বিষণ্ণতা বিলীন হোক প্রশান্তি আসুক মনে, নতুন করে সঞ্চার হোক প্রাণ ক্ষণে ক্ষণে।”

লিখেছেনঃরাফিয়া ইসলাম ভাবনা

RedLive

Related post