বুলিং একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি

 বুলিং একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি

STOP BULLYING

বুলিং, কোন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যাপার নয়। বুলিং, এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে তার জীবনে বুলিং এর শিকার হয়নি! তবুও আমরা এটাকে গুরুতর চোখে দেখিনা আজও। সেটা হতে পারে শারীরিক বা মানসিক।ছোট থেকে বড় এমনকি বৃদ্ধ বয়সের একজনও পারিবারিক বা সামাজিকভাবে বুলিং এর শিকার হোন।আইনগতভাবে সেরকম কোন ব্যবস্থা নেই বলে, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাবে এমন গুরুতর অপরাধের কারণে ক্ষয় হয়ে যায় অনেক জীবন। একজন শিশু বুলিং এর ফলে তার মানসিক অবস্থার যেমন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে ঠিক তেমনি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষও তার নিজের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকে।

বুলিং কিঃ যখন মানুষকে তার কোন বৈশিষ্ট্য, স্বভাব বা অবস্থান নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, হেয় করা হয় তখন সেটাকে বুলিং বলে। শারীরিকভাবে একজন আরেকজনকে আঘাত করাকেও কিন্তু বুলিং বলে।

বুলিং কেন ঘটেঃ প্রতিনিয়ত বয়ে যাওয়া সময় ও জীবনে নানা কারণে বুলিং ঘটে থাকে যে কারো দ্বারা।

বুলিং এর স্বীকারে শিশুর মানষিক বিকাশে বাঁধাগ্রস্ত হয়

১.সাধারণত ছোটদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পারিবারিকভাবে অশান্তি থাকলে,  বাহিরের সঙ্গদোষে তারা অন্য আরেক শিশুর উপর শারিরীক ও মানসিক ভাবে আঘাত করে থাকে।

২. আজকের দিনে মাক্সিমাম বাবা -মাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সন্তানের দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিতে পারছেন না।স্কুল -কলেজে নিয়মিত খোঁজখবর না নেবার কারণে একটা ধারণা নিয়ে দিনের পর দিন সন্তানের খেয়াল রাখার কারণে তাদের সন্তানের অন্যের উপর  নেগেটিভ আচরণগুলো থামানোর কোন ব্যবস্থা তো নেই বরং আরো বেড়ে যায়৷

৩. শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। এ কথা আমরা সবাই জানি। তাই সবসময় আমাদের খেয়াল রাখা দরকার সে কি দেখছে, কি শিখছে। সে যদি তার শিক্ষক বা বড়দেরকে অন্যদেরকে হেয় মনোভাব বা ব্যবহার দেখে তাহলে সেও একই আচরণ করবে।

৪. বড়দের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, সে যখন কোন একসময় অন্যের থেকে কোন বিরুপ আচরণ পেয়ে থাকে তবে একসময় সে যখন সুযোগ পায় অন্য কারো প্রতি রূঢ় ব্যবহার ও কথা বলে থাকে।

৫. ছোট বা বড় যেই হোক কারো প্রতি ক্রোধ, প্রতিহিংসা, মনোমালিন্য থেকেও প্রতিনিয়ত বুলিং ঘটছে।

৬. বুলিং এর স্বীকার সাধারণত তারাই হয় যাদের নিজেদের প্রতি আত্নবিশ্বাস কম, নাজুক স্বভাবের।

বুলিং যেভাবে আমাদের সাথে ঘটছে:

. অনলাইনে বুলিং এর স্বীকার : ছোটদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা অনলাইনে গেমিং এর সময় কিছু আপত্তিকর বিষয়ের সাথে পরিচিত হয় এবং তারা বাজে মানুষদের দ্বারা মন্তব্য, চাহিদার কথা শুনতে হয়। তারা বড়দের সাথে সহজে আলোচনা করতে না পারায় নিজেদের মধ্যেই বিষয়গুলো গুটিয়ে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে  ফেক আইডির যন্ত্রণা, কটু কথার চিত্র দেখা যায়।

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সবচেয়ে বেশি বুলিং স্বীকার হয়

. স্কুলে শারীরিক বুলিং: উঁচু ক্লাস যেমন সপ্তম শ্রেণির কোন ছাত্র/ছাত্রী তার নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সাথে বাজে আচরণ, মারধোর ও কথা বলার ঘটনা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়।আবার একই ক্লাসে দেখা যায়, শক্তিশালী কেউ তার দুর্বল সহপাঠীদের উপর অকারণেই চড়াও হয়।

. বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে: বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে নবীন শিক্ষার্থীদের উপর সিনিয়ররা প্রায়ই    

রাগিং-বুলিং নামক শারীরিক ও মানসিক টর্চার করে থাকে। যেমন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এ ব্যাপারে সবাই শুনে থাকে।

. কর্মক্ষেত্রে: যে কোন কর্মস্থলে দেখা যায়, কোন ব্যক্তির যোগ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থান ও স্বভাব নিয়ে ঠাট্টা-তামাশায় মেতে থাকে একদল নেগেটিভ মানসিকতার লোক। আবার, আমাদের দেশে বস মানে তার সহকর্মীদের সাথে কারণে অকারণে রূঢ় আচরণ করা। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তার নিচের কর্মচারীদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে থাকে।

. মেয়েদের ক্ষেত্রে: মেয়েদের ক্ষেত্রে বুলিং যেন অহরহ ঘটতেই থাকে। পারিবারিকভাবে দেখা যায়, পরিবারের ছেলে বা বয়স্ক ব্যক্তিরা কথার আঘাত দিয়ে থাকে কোন মতামত চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। রাস্তাঘাটে ইভ টিজিং নামক বুলিং ফলে আমাদের সমাজে অনেক মেয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। তার উপর আজকাল ধর্ষণ তো রয়েছেই। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যেন তাদের পুত্রবধূকে নিয়েই আসে নানাভাবে কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য। অফিসে তার ভালো পারফরম্যান্স ও যেন অনেকে সহ্য করতে না পেরে সাফল্য না জানানোর পরিবর্তে তাদেরকে খোটা শুনতে হয়। আজকাল সাইবার বুলিং এর শিকার তারা প্রায়ই হচ্ছে। যেমন, তাদের ছবিতে আজেবাজে কমেন্ট বেড়ে গেছে, তাদের ছবি নিয়ে সেটাকে বাজেভাবে ছেড়ে দেওয়া, মেসেজের মাধ্যমে উত্যক্ত করা, ভিডিও বানানো, লিংক পাঠানো।

কর্মস্থল থেকে শুরু করে প্রায় সব জায়গায় বুলিং এর স্বীকার হয় মেয়েরা

. সামাজিকভাবে: সামাজিকভাবে দেখা যায়, কারো শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও বাহ্যিক অবস্থান নিয়ে অনায়সে একদল মহিলা, পুরুষ অন্যদেরকে আদি অন্ত না ভেবে আজেবাজে কমেন্ট কের ফেলে। যেমন, কেউ মোটা,কালো বা প্রতিবন্ধী হলে তার সামনেই সেটা নিয়ে হাসাহাসি ও খোটা দেওয়া, কারো বাচ্চা হওয়া, না হওয়া নিয়ে কথা শুনানো, কারো আয় কম নাকি বেশি সেটা নিয়ে আয়কৃত ব্যক্তির সামনেই বাজে মন্তব্য করা, কোন শিক্ষার্থী যখন সমাজের গতানুগতিকের বাইরে যেমন উদ্যোক্তা, কৃষক, ফ্রিলান্সার, শিল্পী হতে চাইলে তাদেরকে প্রতিনিয়ত আশেপাশের মানুষদের থেকে নানান কথা সহ্য করতে হয়। রিকশাওয়ালাকে চড় থাপ্পড় মারাটাও কোন ভদ্রলোকের কাজ নয়। যে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে সে যার দ্বারা হয় তাকে খুনের পরিকল্পনাও করে থাকে।

বুলিং এর ফলাফল যেভাবে এর প্রতিরোধ করবেনঃ

. কাউন্সিলিং : ছোট বাচ্চাদের সাথে যখন হয়ে থাকে তখন সে ভয় পেতে থাকে স্কুলে অনিহা ও পরিচিতদের সাথে মিশতে অনিচ্ছুক হয়ে থাকে। সে অবস্থায় তাকে কোন মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শে রাখতে হবে৷

. প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রেঃ একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেটা হয় তারা নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, নিজেকে ঘৃণা করে থাকে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। অবস্থা বেশি শোচনীয় হলে ক্ষুধামন্দা, ঘুম না হওয়া, নিজেকে অন্ধকারে গুটিয়ে রাখা এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেয় কেউ কেউ। সেক্ষেত্রে তাদের কথা শুনতে হবে, তাদেরকে সাহস দিতে হবে। নিজেরা ব্যর্থ হলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

. পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে: কোন সমস্যা হলে দেখা যায়, পরিবারকে অনেকেই বলতে ভয় পায়। বাবা মা বা ভাই বোন যেই হোক তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে তাদের যে কোন বয়সের সদস্য হঠাৎ করে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হলে ছেলেমেয়েরা ড্রাগস নিতে শুরু করে সেটাকে বন্ধু ভাবে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক পরিবারের সদস্যগুলোকে ভালো রাখে। বাবা মার শত ব্যস্ততা থাকলেও স্কুলে নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে।

.প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের যথেষ্ট নজর রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের উপর। যে বুলিং করে তাকে বুঝিয়ে বলা, পরিবারকে জানানো তাদের কর্তব্য। প্রাপ্ত বয়স্কদের  ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মনে করি। কর্মস্থলে বসের উচিত শুধু বসগিরি নয় বরং  সব ধরনের পজিশনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। সহকর্মীদের ও উচিত সচেতন হওয়া আজ আপনি কটু কথার শিকার হয়েছেন বলে এই নয় যে কাল আপনি আরেকজনকে দিবেন বরং তাকে সাহস দেওয়া, তার পাশে থাকা আপনার কর্তব্য।

. সামাজিকভাবে : সামাজিকভাবে বুলিং বন্ধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয় বলে নেগেটিভ মানসিকতা সম্পন্ন কাউকে এড়িয়ে চলাটা মঙ্গলজনক।

৬. যারা বুলিং ঘটায় তাদের প্রতি মনোযোগ : এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা অন্যের উপর আঘাত করে সেটা তারা কেন করছে, কেন থামাতে পারেনা সে নিয়েও আমাদের জানতে হবে। তাদের সমস্যাগুলোও সমাধান করতে হবে।

যে যেমন, সেটা যেমন আমরা পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারবো না তেমনি কারো অবস্থানের জন্যও কারো প্রতি হেয় প্রতিপন্ন করা উচিত নয়। দিন দিন বুলিং যেন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মহামারীর সময়ে অবিশ্বাস্য হারে ঘটে চলছে বুলিং করা ও শিকার হওয়া। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমরা তৎপর না হলে ও এটি তেমন কিছুই না ওসব কত লোকে বলে, কত করে এসব ভেবে এড়িয়ে গেলে ভবিষ্যতে  আরো ভয়ংকর সমস্যা দেখা দিবে৷ ইংরেজিতে একটা চলমান ধারা অনুসারে বলতে চাই, “Keep Clam and Stop Bullying.”

লিখেছেনঃ সামিহা আতিকা

RedLive

Related post