মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা শহীদদের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে শহীদ মিনারের বেদি। প্রভাত ফেরীতে ধ্বনিত হবে একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।
বাংলা মায়ের বীর সন্তানেরা মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে আজ থেকে ৬৯ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই দিনে বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছিল ঢাকার রাজপথ। পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছিল মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের অভূতপূর্ব নজির।ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। অতঃপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে এসে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান(বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, ‘Urdu and only Urdu shall be state language of Pakistan’ (উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা) । উভয় ক্ষেত্রে ছাত্ররা ‘না , না’ বলে প্রতিবাদ জানায়।বিশ্ববিদ্যালয়-অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এতে কোনো কর্ণপাত করেননি।
১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’পালনের কর্মসূচি প্রদান করলে ছাত্র-জনতার মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারার বিধি-নিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে।মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র জনতা অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তা উত্তল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে।মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এতে সারা বাংলায় প্রতিবাদের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। সমগ্র জাতি সম্মিলিতভাবে গর্জে ওঠে সিংহের মত।পরিশেষে শাসকগোষ্ঠীর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়। রক্তঝরা ২১শে ফেব্রুয়ারি যে অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেছিল তার ওপর নতি স্বীকার করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৯ মে,১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আজ স্বীকৃত।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের রক্ত দান বৃথা যায়নি। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি প্রিয় মাতৃভাষা। আমরা পেয়েছি একুশের চেতনা। অর্জন করেছি অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা।ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালীদের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে ও স্বাধীনতা অর্জনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
২১শে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এত ব্যাপক ছিল যে, আজ তা জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাঙালিরাই মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে।এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘The Mother Language Love of the World’ সংগঠনের মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের নিকট ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়। জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারির গতি, প্রকৃতি ও তাৎপর্য সবদিক গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘের ১৬০তম অধিবেশনে ১০৮ দেশের সম্মতিতে উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০০ সালে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ প্রথমবারের মতো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে।
বাঙালি জাতিসত্তার মূলভিত্তি হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। বায়ান্নোর পথ ধরে চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তর সালের জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ধাপে ধাপে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। ২১ শিখিয়েছে কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, কিভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। তাই একুশ মানে অহংকার, একুশ মানে প্রেরণা,একুশ মানে মাথা নত না করা। তাই একুশের এই অহংকার ও গৌরবমণ্ডিত দিনে বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে।
লিখেছেনঃ রওশন আরা অমি