মে দিবসের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

 মে দিবসের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

‘আজ পয়লা মে;আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে এক ঐতিহাসিক দিন। বিশ্বের মেহনতি মানুষের আন্দোলন আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত আজকের এই দিন। বর্তমান সভ্যতা বিনির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের অবদান। তাদের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে আধুনিক বিশ্বের চাকা সচল রয়েছে। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের মাধ্যমে বিশ্বায়নের নির্মাতা দুনিয়ার সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সংহতি, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। যেকোনো দেশের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে সেই দেশের মানবসম্পদ। যথাযথ শিক্ষা, পরিবেশ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকশিত মানবসম্পদ দেশের উৎপাদন, উন্নয়ন ও সামগ্রিক অগ্রগতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

মহান মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়।দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ও শ্রমজীবী সংগঠনগুলো মে দিবস পালন করে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে। উদীয়মান অর্থনৈতিক দিক থেকে অগ্রসরমান বাংলাদেশে মহান মে দিবসের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অপরিসীম। কেননা শ্রমিক অসন্তোষ কোনো সমাজের জন্য শুভকর নয়।বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১লা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরও অনেক দেশে এটি বেসরকারি ভাবে পালিত হয়। যেভাবে এলো মে দিবস- ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়কার কথা। শ্রমিকরা তখন দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও তার বিনিময়ে সামান্য মজুরিও পেতেন না। শিল্প মালিকরাই অধিক লাভ ভোগ করতো। উল্টোদিকে শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করতো। উপরন্তু ছিল মালিকপক্ষের অনবরত অকথ্য নির্যাতন। কখনো আবার তা পৌঁছাতো ক্রীতদাসতুল্য পর্যায়ে! ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাঁদের মজুরি না কমিয়ে সারা দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তাঁরা একটি সংগঠনও তৈরি করেন পরবর্তীকালে, যার নাম হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার। এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের স্লোগান ছিল- “Eight hours for work, eight hours for rest, eight hours for what we will.”

১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। বারবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও একটুও সাড়া মেলে না তাঁদের কাছে। পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ অবধারিত হয়ে উঠছিল। মালিক-বণিক শ্রেণি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। পুলিশ আগেই শ্রমিকদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। আবারও চলল তেমনই প্রস্তুতি। শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে পুলিশকে বিশেষ অস্ত্র কিনে দেন ব্যবসায়ীরা। পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে নেমে আসেন রাস্তায়। আন্দোলন চরমে ওঠে।৪ মে, ১৮৮৬ সাল। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চারিদিকে হালকা বৃষ্টির সাথে হিমেল হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন।( তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন)অগাস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে মেথিয়াস জে. ডিগান নামের একজন পুলিশ তৎক্ষণাৎ এবং আরও ছয়জন পরবর্তীতে নিহত হয়।এর ফলস্বরূপ সাথে সাথে পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই দাঙ্গায় ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে অগাস্ট স্পীজ-সহ মোট আটজনকে প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে অস্কার নীবেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।ফাঁসি দেয়ার আগেই কারারুদ্ধ অবস্থায় ‘লুইস লিং’ নামের একজন আত্মহত্যা করেন। বাকি ছয়জনের মধ্যে তিনজনকে ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর তারিখে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেয়া হয়।যদি ও পরবর্তীতে এই মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।। পুলিশের কমান্ডারকে হেমার্কেট দাঙ্গা ও ওই বিতর্কিত বিচারকার্য পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল সেসময়। ইউরোপে এ ঘটনার পর ১৮৯০ সালে গড়ে ওঠে সমাজতান্ত্রিক ও লেবার পার্টিগুলোর নতুন জোট- সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল।। হেমার্কেটে শহীদদের সম্মানে সমাবেশের ডাক দেয় ওই জোট। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ওই বছর লন্ডনে ১ মে ৩ লাখেরও বেশি লোক এক সমাবেশে সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা নিশ্চিতের পক্ষে বিক্ষোভ করে পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে বহু সরকার ওই শ্রমিকদের ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানায়।তবে মে দিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯০৪ সালে। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধিদের ষষ্ঠ কংগ্রেসের আয়োজন করা হয় ওই বছরের ১৪ থেকে ১৮ আগস্ট। অ্যামস্টারড্যামে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসটি দ্য ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস হিসেবে পরিচিতি পায়। এতে অংশগ্রহণ করেন ইউরোপের সকল দেশের সব সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। সেদিনই আইনের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য একদিনে সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানানো হয়। স্বীকৃতি পায় শ্রমিক দিবস।সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। বাংলাদেশে মে দিবসের সূচনা- উপরের ইতিহাসটি আমরা কমবেশি সবাই জানলে ও বাংলাদেশে মে দিবসের সূচনা কীভাবে হয় তা আমরা অনেকেই জানি না।দেশ বিভাগের আগে থেকেই এই দিনটি বাংলায় যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। অবিভক্ত বাংলায় তৎকালীন ভারতে মে দিবসের সূচনা হয় বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ১৯২৩ সালের ১ মে, মাদ্রাজের সমুদ্রসৈকতে শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চেটিয়ারের সভাপতিত্বে ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয়েছিল। সেই সভা থেকেই এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল।তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় ১৯২৭ সালে প্রথম মে দিবস পালন করা হয়। দেশ বিভাগের পূর্বে নারায়ণগঞ্জে মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৮ সালে।১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সালের মে মাস পর্যন্ত মে দিবস সীমিত পরিসরে পালিত হয়। ১৯৫৩ সালে পল্টনে মে দিবসের জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়।

তবে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশের শ্রমিকরা প্রথমবারের মতো বিপুল উৎসাহ নিয়ে মে দিবস পালন করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শ্রমিকদের বিরাট অংশ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে। ১৯৭০ সালে মে দিবস পালনে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ করা যায়।১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবসটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বঙ্গবন্ধু ১ মে-কে মহান মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালের মহান মে দিবস উপলক্ষে তৎকালীন সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু মহান মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস উদযাপন-

ভারতের মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে বিশেষ মর্যাদায় দিনটি পালিত হয়। আসামে এই দিনের জন্য বিশেষ সংগীত রয়েছে। তারা সেটি গেয়ে গেয়ে দিনটি পালন করেন। আর্জেন্টিনায় বিশ্বের সর্ব প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৮৯০ সালে। ১৯৩০ সালে সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়। মে দিবসে দেশটিতে সাধারণ ছুটি থাকে। এদিন তাদের বড় বড় শহরের প্রধান সড়কে শ্রমিক শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে জাঁকজমকপূর্ণভাবে মে দিবস পালিত হয়। তারা সেদিন আগুন জ্বালিয়ে শিকাগো শহরে নিহতদের স্মরণ করে।

চীন ও কিউবা রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি উদযাপন করে। এদিন তারা সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। বের করে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বলিভিয়ায় ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিন শ্রমিকদের সম্মানে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

ব্রাজিলে শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটিতে ছুটি থাকে। এদিন ঐতিহ্যগতভাবে অধিকাংশ পেশাদার বিভাগের ন্যূনতম বেতনকাঠামো পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ফলে শ্রমিকদের দিনটি আনন্দের। নেপালে সরকারি ছুটি থাকে। এদিন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে বড় শ্রমিক সমাবেশ ও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পর্যটক ছাড়া অন্যান্য যানবাহনও বন্ধ থাকে। জাপানে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে দিনটি পালিত হয়। এদিন জাপানের রাজধানী টোকিওতে শ্রমিকরা পদযাত্রা ও বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করেন।

জার্মানিতে জাতীয় ছুটি হিসেবে দিনটি পালিত হয়। এদিন বার্লিনে শ্রমিকদের বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন মেলার আয়োজন করে থাকে। হাঙ্গেরিতে সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হয়। এদিন তারা বিশেষ নাচ পরিবেশন করে দিনটিকে আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।

ইউরোপজুড়েই মে দিবসে থাকে সরকারি ছুটি। তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দিনটি পালন করে। এ জন্য বিশেষ নাচ-গানের ব্যবস্থাও রয়েছে। বড় বড় শহরে অনুষ্ঠিত হয় শ্রমিক সমাবেশ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এ দিনটি উপলক্ষে বিশেষ বোনাস দেয়ার রীতিও চালু রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ায় মে দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে মে ট্রি বা গাছ। একটি বৃক্ষ আকৃতির উঁচু বস্তুকে ঘিরে তারা নাচ-গানের আয়োজন করে।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মে দিবস পালিত হয়। তবে যে দেশে এই ঘটনার জন্ম, সেই দেশ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে দিনটি সরকারিভাবে পালিত হয় না। এ ছাড়া তাদের প্রতিবেশী দেশ কানাডায় দিবসটি সরকারিভাবে পালন করা হয় না। তবে বেসরকারিভাবে কিছু শ্রমিক সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা ও র্যালি বের করে।আমেরিকা ও কানাডাতে সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়।কারণ হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা মে তারিখে যে কোনো আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন ও নাইটের সমর্থনে তিনি ১৮৮৭ সাল থেকেই সেপ্টেম্বরে শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

বর্তমানে মে দিবসের তাৎপর্য

সংগ্রামী দিনগুলোর যে তালিকা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার মধ্যে মে দিবস অনন্য। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে এই দিন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটের সামনে শ্রমিক আন্দোলনের সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী এই দিন পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে।আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল এই দিনের মূল প্রতিপাদ্য। আট ঘন্টা শ্রম দিয়ে দিনের বাকি সময় ঘুম-শারীরিক বিশ্রামসহ পারিবারিক-ব্যক্তিগত কাজের সময় চেয়ে শ্রমিকরা সেদিন আন্দোলনে নেমেছিলেন। শ্রমিকরা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন। কেননা সুস্থ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে গেলে দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করা উচিত নয়। দৈনিক কর্মঘন্টা আট ঘন্টা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়েই মে দিবসের এই লড়াইয়ের সূত্রপাত।আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তখনকার শ্রমিকরা এই অধিকার আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। ইউরোপ, আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের অধিকার। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলোতে এটা করা সম্ভব হয়নি। অনুন্নত দেশগুলোর কলকারখানা মালিকরা কাগজে-কলমে আট ঘণ্টা কাজের দাবি মানলেও বাস্তবে তা বিরাজ করে না।

আজ শুধু শ্রমিকরা নন যারা বহু বেতনের কর্পোরেট কাজ করেন তারাও এখন আর এই নিয়ম মানতে পারেন না। সে হিসাবে মানুষকে স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে চিন্তা করা হয় না এখন।বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি সাধারণ শ্রমিক তো বটেই, উঁচু বেতনের কর্পোরেট শ্রমিকের জীবন থেকেও স্বাভাবিক বিশ্রাম বিনোদন কেড়ে নিয়েছে। সে হিসাবে মে দিবসের তাৎপর্য আজ আর অনেকের জীবনেই সত্য বলে প্রতীয়মান হয় না।আমাদের মতো দেশে শ্রমিকরা এক অর্থে মানবেতর জীবন যাপন করে থাকেন। যে জীবনকে সচল রাখতে জীবিকার প্রয়োজন সেই জীবিকা অর্জনেই তাদের জীবন শেষ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবস-

বাংলাদেশের শিল্পখাত এখনো পূর্ণমাত্রায় বিকাশ লাভ করেনি। তাই আমাদের বেশিরভাগ শ্রমিকরা কাজ করে প্রধানত এক অবিকশিত শিল্পখাতে। কেননা আমাদের সকল শিল্পখাত, সকল শ্রমখাত এখনো পূর্ণ শ্রমআইন মেনে শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য সকল সুবিধাদি নিশ্চিত করে বিকশিত হতে পারেনি। সেকারণেই এখানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও শ্রমিকরা পায় না ন্যায্য মজুরি। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা সেভাবে নিশ্চিত হয়না। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যারা নিয়োজিত তাদের ক্ষেত্রেও এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।আমরা স্মরণ করতে পারি রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা। বলা হয় এটি ছিল শিল্প ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রাণহানিপূর্ণ দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় নিহত, নিখোঁজ, শারীরিকভাবে পঙ্গু বা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা এখনো তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পায় নাই। যদিও দেশি-বিদেশি ক্রেতা-সামাজিক সংগঠন-সরকারের চাপে এই দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অনেককেই আর্থিক অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়নি। আামাদের মনে রাখতে হবে গার্মেন্ট খাত হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত ও শক্তিমান খাত। এখানে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। নারী শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য রয়েছে এখানে।বিদেশি ক্রেতা, বিদেশি সামাজিক সংগঠন সহ দেশি নানা সংগঠন, প্রাতষ্ঠানের গভীর দৃষ্টি রয়েছে এই খাতের ওপর। তারপরও এখানকার শ্রমিকরা এখনও ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি অধিকার পাননি। যদিও ট্রেড ইউনিয়নের অপব্যবহার আমাদের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিপথে ঠেলেছে অতীতে, তবুও এই অধিকার শ্রমিকদের ন্যায্যতা রক্ষার একমাত্র কবজ। সরকার ও মালিকপক্ষের চাপে গার্মেন্ট খাতের শ্রমিকরা এই অধিকার থেকে এখনো বঞ্চিত। বাংলাদেশে সকল পেশার শ্রমিকরা খুবই আদিম ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাদের শ্রমজীবন অতিবাহিত করে। তাদের কষ্টকর জীবনকে সহনীয় করতে কয়েকটি পদক্ষেপের দিকে লক্ষ্য রাখা যেতে পারে।

শ্রমিকরা যা আয় করে আর তাদের ব্যায়ের মধ্যে এখনো সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। শহর এলাকায় শ্রমিকদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় আবাসন খাতে। ঢাকা মহানগরে একজন গার্মেন্ট শ্রমিক তার আবাসন বাবদ প্রতি বর্গফুটে যে টাকা খরচ করে তা অনেকসময় মধ্যবিত্তদের ফ্ল্যাটবাড়ির চেয়েও বেশি। সরকারি-বেসরকারি-মালিকপক্ষের উদ্যোগে সাশ্রয়ীমূল্যে শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

শ্রমিকদের পুষ্টিমান নিশ্চিত করার সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনার পথ উদ্ভাবন করা দরকার। এক্ষেত্রে রেশন কার্ডপ্রথা চালু করা যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গায় শিশুশ্রম চালু আছে। শিশুশ্রমিকদের পূনর্বাসন নিশ্চিত করে তাদের জীবনকে সহনীয় করা যেতে পারে।

পরিবহণ ক্ষেত্রে শ্রমিকরা খুবই মানবেতর অবস্থায় কাজ করে। এই খাতে শ্রমিকদের কাজ বা চাকুরি একটা নিয়মনীতির আওতায় এনে ন্যূনতম মানবিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।

পরিশেষ-

বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। সেই আয়ু যাতে সুন্দরভাবে মানুষ যাপন করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে দেশের জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ শ্রমিকদের জীবনমান মর্যাদাময় করার দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এই কাজটি রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্রকে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি মানবিক হতে হবে। শুধু মালিকপক্ষের স্বার্থ নিশ্চিত করার দিকে রাষ্ট্র মনোযোগী হয়ে উঠলে তাকে ন্যায্য রাষ্ট্র বলা যাবে না।আমাদের শিল্পখাতে আমরা রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করছি শিল্প পুলিশের সৃষ্টি ও বিকাশে। শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলন দমনে এই বাহিনী যথেষ্টই তৎপর। কিন্তু রাষ্ট্রকেও ভাবতে হবে, কেন শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম দাবি আদায়ে মাঠে নামে? শ্রমিকদের অভূক্ত রেখে, অসন্তুষ্ট রেখে, ক্ষুব্ধ রেখে আমরা যে রাষ্ট্র গড়ে তুলবো তা কতিপয়ের রাষ্ট্র হতে পারে কিন্তু তা সর্বসাধারণের রাষ্ট্র হবে না।মে দিবসের লড়াই ছিল সর্বসাধারণের জন্য,এক মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ নিশ্চিত করার শ্রমিকশ্রেণীর লড়াই। সে লড়াই এখনো চলমান। তাই মে দিবসের তাৎপর্য আজও গুরুত্ববহ।

লিখেছেনঃ মারজানা মোশাররফ পূর্ণতা

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।