মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
রক্তের ২১কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে স্বীকৃতি

“আম্মি, মুঝে তুমছে মহব্বত হায়।
আপ কি মাদরি জাবান কিয়া হাই।”
কি? কয়েকটা উর্দু দেখে খুব রাগ! ঘৃণা উঠেছে না আপনার! ভাবছেন, এই ভাষা চাইনা? আমার ভাষা, বাংলা ভাষা৷ আমার নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের ভাষা, শুধুই বাংলা।
হ্যাঁ এমনটাই মনে হয়েছিলো বাংলার কতগুলো দামাল সন্তানদের। তারা মায়ের ভাষা ছাড়া আর অন্য কোন ভাষায় বুলি চায়নি।
আন্দোলনের শুরু
বাংলা ও উর্দু ভাষার দ্বন্দ্ব দেশ বিভাগের আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে বীর নেতা শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক তার বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ভারতে যেমন তাদের এক এক প্রদেশ এর ভাষার উপর নিজেদের স্বতন্ত্র ছিলো তেমনি এপার বাংলা তা থেকে বঞ্চিত হয়। যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ভাই – ভাই হওয়ার কথা ছিলো সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী বেশি হলেও পশ্চিম পাকিস্তান ঘষেটি বেগমের ন্যায় আচরণ করে তার উর্দুকে নিয়ে। এক এক প্রদেশে তাদের নিজেদের ভাষার অধিকার যেখানে রয়েছে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান অন্যায় আবদার করে বশে। যার দরুন ১৯৪৭ সালে ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উর্দুকে রাষ্টভাষা করার দাবি জানালে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এনামুল হক এবং আরো কিছু বুদ্ধিজীবি তার বিরোধিতা করেন৷ ১৯৪৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলা ভাষার ব্যবহার উল্লেখ করলে তার দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। যার ফলে বাংলায় মানে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় জোরালো প্রতিবাদ। সে বছরই পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন, ” উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” উপস্থিত ছাত্ররা জোরালো স্বরে না দাবি জানায়। একই বছরে ১৭ নভেম্বর তাজউদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো কয়েকজন স্মারকলিপি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে প্রদান করলে কোন সাড়া পাওয়া যায়না।
২১ শে ফেব্রুয়ারির আগমন
এতকিছুর পরেও চলতে থাকে আলোচনা, সমালোচনা। ১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ২৭ জানুয়ারি উর্দুকে সমর্থন করার ফলে ঢাকায় ছাত্রবৃন্দ ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ধর্মঘট ৪ ফেব্রুয়ারী ও সারা দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ২১ ফেব্রুয়ারি। ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে সকাল ৯ টা থেকে শুরু হয় প্রতিবাদের আনাগোনা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সমবেত হলে বেলা ১১ টায় উপাচার্য, শিক্ষকগণেরা ছাত্রদের উপর কাদুঁনে গ্যাস ছেড়ে দিতে নিষেধ করে। ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও এর সামনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয় যাতে তারা আন্দোলন করতে না পারে। বেলা ৩ টার দিকে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর প্রবল হারে গুলি বর্ষণ হয়। শহীদ হয় সালাম, বরকত, শফীক, জব্বার আরো অনেক জানা, অজানা ভাই বোন৷ ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয় যার উচ্চতা ছিলো ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া। নকশা অঙ্গন করেছিলেন বদিউল আলম, তদারকিতে ছিলেন শরফদ্দীন নামের একজন ইঞ্জিনিয়ার, দুইজন রাজমিস্ত্রী। কিন্তু তা ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ভেঙ্গে ফেলে। ১৯৫৭ সালে সরকারিভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় যার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা ১৯৬৩ সালে। একুশে ফেব্রুয়ারির গান, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটির রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। বর্তমানে গানটি জাপান ও সুইডিশ ভাষায় অনূদিত করা হয়েছে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “বাংলা ও উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
কানাডার দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন পেশ করেন৷ পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ১৮৮ টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের দেশগুলোতে পালন করা হয়।
বর্তমানে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করে পৃথিবীর নানা দেশ উদযাপন করে নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। বাংলার দামাল ছেলেরাই সর্বপ্রথম দেখিয়ে দেয়, ভাষা মানেই আমার মায়ের থেকে শোনা প্রথম বুলি। অন্য কারো থেকে নেওয়া নয়। দেখবেন, নিজের মাতৃভাষায় যতটা সুন্দর, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে পারবেন অন্য কোন ভাষায় তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ আমরা বাঙালিরাই পেরেছি।
লিখেছেনঃ সামিহা আতিকা
ফিচার ইমেজ ও ব্যবহৃত সকল ছবি ক্রিয়েটেড বাইঃ
হাসিন মাহতাব
ক্যাম্পাস এক্সেকিউটিভ, রেড লাইভ
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
All rights reserved by RED LIVE