মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে শেখ রাসেল মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট
শিকড়ের সন্ধানে: স্বাধীন রাজ্য ও পাল শাসন (পর্ব-০৩)

ক্রমাগত হূণ আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য যখন পতনের মুখে ঠিক সেই সময়েই বিভিন্ন বংশ ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে স্বাধীন ভাবে পরিচালনা করা শুরু করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উত্তর ভারতের পুষ্যভুতি বংশ, মৌখরি বংশ, গৌড় বংশ এবং দক্ষিণ ভারতের বাতাপির চালুক্য বংশ।
উত্তর ভারতে মগধ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং কনৌজের মৌখরি বংশের রাজা গ্রহবর্মণের বিরোধ বাধে। ঠিক সেই সময়েই গ্রহবর্মণ থানেশ্বরের পুষ্যভুতি বংশীয় রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিয়ে করেন। এর ফলে মৌখরি বংশ এবং পুষ্যভুতি বংশ একত্রিত হয়ে শক্তিশালী জোটে পরিণত হয়। শশাঙ্ক তখন মালবের রাজা দেবগুপ্তের সাথে একত্রিত হয়ে কনৌজ আক্রমণ করেন এবং জয় করেন। থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজ্যবর্ধন মালব আক্রমণ করে দেবগুপ্তকে হত্যা করেন।
কিন্তু এর পরেই শশাংক বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজকে সম্মিলিত করে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন। এবং কনৌজ ছিল তাঁর সময়কালের রাজধানী।
হর্ষবর্ধন সিংহাসন আরোহণের পর শশাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেন নি।
বাংলার প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজা ছিলেন শশাংক। তাঁর সময়কালে গৌড়ের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। হর্ষবর্ধন বেশ কয়েকবার শশাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেও শশাংক কখনোই পরাজিত হন নি। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত শশাঙ্ক গৌড়,মগধ, দণ্ডভুক্তি, উৎকল ও কঙ্গোদের অধিপতি ছিলেন।
শশাংকের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন মগধ,উড়িষ্যা,পশ্চিমবঙ্গ জয় করেন। ঠিক সেই সময়েই বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে অস্থিরতা দেখা দেয়। প্রথমেই শশাঙ্ক নির্মিত গৌড় রাজ্য কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ এবং হর্ষবর্ধনের মাঝে বিভক্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে হর্ষবর্ধন এবং ভাস্করবর্মণের মৃত্যুর পর সমগ্র বাংলায় অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয় এবং ক্ষমতার জন্য তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। এই সুযোগে বিভিন্ন বহিঃশত্রুর আক্রমণে বাংলার রাজনৈতিক অনৈক্য ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাংকার রাজনীতির এই দুর্দিনকে ” মাৎস্যন্যায় ” নামে অভিহিত করা হয়।এবং এই বিশৃঙ্খলা প্রায় একশ বছর পর্যন্ত চলমান ছিল।
প্রায় একশ বছর ধরে গোটা বাংলা চরম বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতার মাঝে ডুবে গিয়েছিল। ক্ষমতার লড়াইয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো মত্ত হয়ে পড়েছিল। কেউ কারো অধীনস্থ না হয়ে সিংহাসনে আরোহিত রাজাকে হত্যা করে নিজে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতো এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছিল। এরূপ চলমান অরাজকতায় বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তখন বাংলার নেতৃস্থানীয়রা সম্মিলিত ভাবে নিজেদের মধ্য থেকে একজন কে রাজা নির্বাচন করে তাঁর আধিপত্য মেনে নেয়। এবং সেই নির্বাচিত রাজাই হলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা ” গোপাল”। উৎকীর্ণ খালিমপুর তাম্রশাসন এবং নারায়ণ পালের ভাগলপুর তাম্রপট থেকে জানা যায়, মাৎস্যন্যায় দূর করার জন্যেই ” প্রকৃতিপুঞ্জ” অর্থাৎ জনসাধারণ গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেছিলেন।
উৎকীর্ণ খালিমপুর তাম্রশাসন এবং নারায়ণ পালের ভাগলপুর তাম্রপট থেকে জানা যায়, মাৎস্যন্যায় দূর করার জন্যেই ” প্রকৃতিপুঞ্জ” অর্থাৎ জনসাধারণ গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেছিলেন।
গোপাল সিংহাসনে আরোহণ করার পর পরই সমগ্র বাংলার শান্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করায় মনোনিবেশ করেন। এবং দীর্ঘ একশ বছর পর বাংলার রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে গিয়ে গোপালের রাজত্বকালের একটি দীর্ঘ সময় কেটে গিয়েছিল। রাজ্য বিস্তারে গোপালের অবদান খুব বেশি না থাকলেও তিনি পাল সাম্রাজ্যের একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে যান যার ফলে পরবর্তীকালে সেই সাম্রাজ্য প্রায় চারশ বছর ধরে বাংলার ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছিল।
গোপালের পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তখন থেকেই পাল সাম্রাজ্যের বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। ধর্মপাএর বিচক্ষণতা এবং দক্ষতার মাধ্যমেই প্রাচীন এই সাম্রাজ্য গৌড় ও মগধের বাইরেও উত্তর ভারতে বিস্তার লাভ করেছিল।
ধর্মপাল সিংহাসন আরোহণের পরেই উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বাংলার পাল বংশ, মালবের গুর্জার প্রতিহার বংশ এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশের মাঝে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই তিনটি শক্তির সংঘাতই ইতিহাসে ” ত্রিপক্ষীয় সংঘাত” নামে পরিচিত।
পাল বংশের ধর্মপাল পূর্বদিক হতে এবং গুর্জার প্রতিহার বংশের বৎসরাজ পশ্চিম দিক হতে উত্তর ভারতে অভিযান পরিচালনা করলে তাদের মাঝে প্রথম সংঘাত হয়। এই সংঘাতে ধর্মপাল পরাজিত হন। বৎসরাজ উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে করতেই দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশের ধ্রুব রাজ বৎসরাজকে পরাজিত করেন।
বৎসরাজ রাজস্থান পালিয়ে যান। ধর্মপাল ধ্রুবরাজের বিরুদ্ধের যুদ্ধ করলে তিনিও পরাজিত হন। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে ধ্রুব রাজ কে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যেতে হয়। আর ভাগ্যের জোরে ধর্মপালের উত্তরভারতমুখী রাজ্য বিস্তারের পথ সুগম হয়।
ধর্মপাল প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু অংশবিশেষ জয় করেছিলেন। সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে যখন ধর্মপাল রাজত্ব করছিলেন ঠিক তখনই ত্রিপক্ষীয় সংঘাতের পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রতিহার বংশে তখন রাজত্ব করছিলেন বৎসরাজ পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট। তিনি পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পুনরায় কনৌজ আক্রমণ করেন। এবং ধর্মপালের সাথে সংঘর্ষে ধর্মপাল পুনরায় পরাজিত হন। এদিকে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রকূট বংশের তৃতীয় গোবিন্দ প্রতিহার বাহিনীকে পরাজিত করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রকূটের তৃতীয় গোবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে শক্তি শূন্যতার সুযোগে ধর্মপাল পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।
ধর্মপালের রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্যের শিক্ষা সংস্কৃতিরও উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছিল। তিনি মগধে ” বিক্রমশীলা বিহার” স্থাপন করেন। বর্তমান পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ধর্মকালের রাজত্বকালেই নির্মিত হয়েছিল।
ধর্মপালের মৃত্যুর পর ৮১০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দেবপাল। পিতার মতোই তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং দক্ষ শাসক। তাঁর শাসনামলেই পাল সাম্রাজ্যের গৌরব চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিল।
দেবপাল সমগ্র উত্তর ভারতের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশ ও জয় করেছিলেন। তাঁর শাসনামলেও ত্রিপক্ষীয় সংঘাত অব্যাহত ছিল। এবং প্রথমবারের মতো প্রতিহারের রাজা মিহিরভোজ দেবপালের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন।
দেবপালের সুখ্যাতি ভারতবর্ষের বাইরেও সুমাত্রা, যবদ্বীপ, মালয় দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।নালন্দা লিপি থেকে জানা যায়, জাভা ও সুমাত্রার শৈলেন্দ্র রাজ নালন্দায় মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য দেবপালের নিকট পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করেছিলেন।দেবপাল নালন্দা মঠ নির্মাণের জন্য শৈলেন্দ্র রাজকে পাঁচটি গ্রাম দান করেছিলেন।
বলা বাহুল্য যে দেবপাল বাংলার ইতিহাসে সাম্রাজ্য বিস্তার এবং সুসংগঠিত শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক হলো দেবপালের মতো তাঁর উত্তরাধিকারীরা এতো যোগ্য শাসক ছিলেন না। ফলশ্রুতিতে পাল সাম্রাজ্যের গৌরবান্বিত অধ্যায় ধীরে ধীর ম্লান হতে থাকে।
দেবপালের পর প্রথম বিগ্রহপাল সিংহাসনে আসীন হন।এরপর নারায়ন পালের রাজত্বকালেই পাল সাম্রাজ্যে বহিরাক্রমণ ঘটে। ধীরে ধীর পাল সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। এমনকি সমগ্র বাংলা থেকে পালদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কেবলমাত্র মগধেই পালদের শাসন ব্যবস্থা কোনোমতে টিকে ছিল। এরূপ দৈন্য অবস্থাতেই পাল সাম্রাজ্যের ত্রাণকর্তা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপাল।
পাল সাম্রাজ্যের দীর্ঘ অবক্ষয়ের পর মহীপাল পুনরায় পাল সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে পাল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে মহীপালের রাজত্বকাল বেশ গুরুত্ব বহন করে। অস্তগামী পাল সাম্রাজ্যের গৌরবকে তিনি পুনরুদ্ধার করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে গভীর আস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু সেই গৌরবোজ্জ্বল সময় খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রথম মহীপালের মৃত্যুর পরেই পুনরায় পাল সাম্রাজ্যের ভাংগন শুরু হয়।
পাল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সর্বশেষ গৌরবের ইতিহাস ছিল রামপালের। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন পূর্ব পুরুষদের জন্মভূমি পুনরুদ্ধার করে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। তিনি অনেকাংশে সফল হলেও তাঁর পরবর্তী রাজারা তেমন কোনো যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারেন নি। এমন কি পাল রাজারা নিজেদের মাঝেই অন্ত কলহে লিপ্ত হয়েছিল। আর এই দুর্বলতার সুযোগে বিভিন্ন বহিঃশত্রুর আক্রমণে পাল সাম্রাজ্য ক্রমশই পতনের দিকে অগ্রসর হতে থাকল।
অবশেষে শেষ পাল রাজা মদন পালের মৃত্যুর পর দীর্ঘ চারশ বছর রাজত্ব করা পাল সাম্রাজ্যের পতাকা একেবারেই অবনমিত হয়ে যায়। উত্থান পতনের স্বাভাবিক গতিতে একদিকে যেমন পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে অন্যদিকে তেমন ধীরে ধীরে সেন বংশের উত্থান ঘটে। এবং বাংলার ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
লিখেছেনঃশরিফ মেহেরিয়া