শীতলপাটি : ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের অতুলনীয় নিদর্শন

 শীতলপাটি : ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের অতুলনীয় নিদর্শন

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় সম্মানজনক একটি স্থান দখল করে আছে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের অতুলনীয় নিদর্শন, ‘শীতলপাটি’। নাম যার শীতলপাটি, শীতলতার খোঁজ তো তার কাছেই পাওয়া যাবে, তাই না? ঠিক তাই! গরমের দিনে একটুখানি শীতলতার খোঁজ দেয়ার জন্য শীতলপাটির জুড়ি মেলা ভার। আর শীতলপাটির জানা অজানা হরেক রকমের কথা নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের আলোচনা।

শীতলপাটি কেন শীতল?

‘শীতল’ শব্দটি শোনার সাথে সাথেই যেন ঠান্ডা বা শীত অনুভূত হয়। আর ‘পাটি’ বলতে আমরা মূলত মাদুর বা বিছানার মতো দ্রব্যকে বোঝাই। তাহলে শীতলপাটির মানে দাঁড়ায় শীতল বিছানা কিংবা ঠান্ডা মাদুর। প্রশ্ন হচ্ছে, বিছানা বা মাদুর কীভাবে শীতল হতে পারে? রহস্যটা কী?

রহস্যটা মূলত লুকিয়ে আছে শীতলপাটি তৈরির কাঁচামালের মধ্যে। কেননা শীতলপাটি তৈরি করতে চাই এক ধরণের শীতল ও মসৃণ প্রকৃতির গুল্ম, যার নাম ‘মুর্তা’। ‘পাটিবেত’ হিসেবে পরিচিত এই গুল্ম উদ্ভিদ মূলত শীতলপাটি বোনার জন্যই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু শীতলপাটি বোনার জন্য কোন ধরণের প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করা হয়?

কীভাবে বোনা হয় শীতলপাটি?

ছবিঃ শীতলপাটির বুননের একাংশ

শীতলপাটি বোনার পুরো প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সময় দিতে হয়। প্রথমে মুর্তা গাছের কান্ডের দিকের অংশটা কেটে নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে পরিষ্কার করা হয়। চার ফালিতে বিভক্ত করা হয় সেই মুর্তা গাছের কান্ড। এসময় কান্ডের ভেতরে এক ধরণের সাদা অংশ দেখতে পাওয়া যায়। ‘বুকা’ হিসেবে পরিচিত সেই সাদা অংশ অপসারণ করা হয়।

সর্বোপরি, শীতলপাটি বোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হয় মুর্তা গাছের সংগৃহীত ছাল অর্থাৎ বেতীকে চিকন ও পাতলা করার কাজে। কেননা বেতী যত চিকন আর পাতলা হবে, শীতলপাটি হবে তত মসৃণ, নরম আর আরামদায়ক!

নকশীপাটি কী জিনিস?

মুর্তা গাছ থেকে প্রাকৃতিকভাবে সংগৃহীত বেতীর রঙ হয় বাদামী। বাদামী বেতীর সঙ্গে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের রঙের গুঁড়া ভাতের মাড়ের সাথে সিদ্ধ করে পাওয়া যায় হরেক রকমের রঙিন বেতী। আর এইসব রঙিন বেতী মিলিয়ে মিশিয়ে নকশাদার বুননের মাধ্যমে যে শীতলপাটি তৈরি করা হয়, তার নাম নকশীপাটি। নকশীপাটি মূলত এক ধরণের জনপ্রিয় শীতলপাটি।

ছবিঃ বিভিন্নধরনের নকশী পাটি

শীতলপাটি কত প্রকারের হয়ে থাকে?

নকশা, মসৃণতা কিংবা বুননশৈলীর উপর ভিত্তি করে শীতলপাটি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সবচেয়ে সেরা মানের মসৃণ শীতলপাটির নাম ‘সিকি’। কথিত আছে; মসৃণতার কারণে সিকির উপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে ব্যর্থ হয়। মাত্র একটি সিকি বুনতেই চার থেকে ছয় মাস সময় লেগে যায়। আরেক ধরণের কারুকার্যমণ্ডিত শীতলপাটির নাম ‘আধুলি’। আধুলি বুনতে সিকির তুলনায় কম সময় লাগে। ‘টাকা’ হিসেবে পরিচিত শীতলপাটি আকারে বেশ বড়সড় হয়। কাজেই নকশাদার ‘টাকা’ বোনার জন্য অনেক বেশি সময় লেগে যায়। এখন অবশ্য সাধারণ কিছু শীতলপাটি প্রচলিত রয়েছে, এক থেকে দুই দিনের মধ্যেই যেগুলো উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু হ্যাঁ, নকশা, মসৃণতা কিংবা বুননশৈলীর কার্যভেদে নির্ধারণ করা হয় শীতলপাটির দাম। এক্ষেত্রে একটি শীতলপাটির দাম হতে পারে ২ থেকে শুরু করে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত!

বাংলাদেশের কোন স্থানের শীতলপাটি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত?

বাংলাদেশের সিলেটের শীতলপাটি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। কারণ সিলেটের বালাগঞ্জের শীতলপাটি সবচেয়ে সেরা। আর তাই সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বোনার ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করেছে ইউনেস্কো।

তাছাড়া নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলায় অনেক ভালো মানের শীতলপাটি পাওয়া যায়।

আজকালকার আধুনিক যুগে মাদুর বা বিছানা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিক পণ্য। ফলে কমতে শুরু করেছে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির কদর। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের শীতলপাটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে।

লিখেছেন : নবনীতা প্রামানিক

RedLive

Related post