সিলেটের ঐতিহ্যবাহী হালতি গান কি!

 সিলেটের ঐতিহ্যবাহী হালতি গান কি!

সিলেট তথা ভাটি অঞ্চলে হালতি গানের চর্চা দুইশ থেকে আড়াইশ বছরের। পূর্বে হালতি গানের বেশ প্রচলন ছিল।বৃহত্তর সিলেটের সিলেট সহ আরও তিন জেলা তথা সুনামগঞ্জ,হবিগঞ্জ,মৌলভীবাজার অঞ্চলের কিছু এলাকায় এই হালতি গানের আসর বসত নিয়মিত। স্থানীয় লোকজন এই হালতি গানকে “কালাম” হিসেবেও অভিহিত করতেন।

হালতি গান মূলত জিকির জাতীয় ফকিরালি পর্যায়ের গান।বিশেষত মরমি সাধক আরকুম শাহ ও তার শিষ্য অনুসারী দ্বারা এ গান ব্যাপক বিস্তার পেয়েছে।কালা শাহ,লাল শাহ,শেখ ভানু,বিতলা শাহ,কুতুব আলী শাহ সহ অনেকের লেখা গানই এই হালতি গানের আসরে গাওয়া হত।

হালতি গানের পরিবেশনরীতি:

এই গানের পরিবেশনরীতিতে ভিন্নতা রয়েছে। পাক পাঞ্জাতনের নামে পাঁচটি বাতি জ্বালিয়ে বাড়ির ভেতরে কিংবা উঠোনে এ গানের মাহফিল বসানো হয়।কোনো কারণে কেউ মানত করলে এই হালতি গানের আসর বসাতেন পরম ভক্ত শিষ্যরা।আবার কেউ নতুন ঘর তৈরী করলেও এ গানের মাহফিলের আয়োজন করতো।সারারাত ব্যাপী এই আসর চলতো।ওযু করে পাক পবিত্র হয়েই ভক্তরা আসরে উপবিষ্ট হতেন।

আসরের শ্রোতারা হালকা জিকির করে থাকেন।”হালকা জিকির” মানে প্রতি অন্তরার শেষে তারা সমস্বরে সুর করে “আল্লাহু আল্লাহু” বলে থাকেন।এ গানের আসরে সাধারণত পির- মুর্শিদের প্রশংসা,নবীর শানে,খাজার শানে,আল্লাহ্‌র শানে জাতীয় গানই বেশি পরিবেশিত হয়। এর বাইরে বিচ্ছেদ,বাঁশি,আক্ষেপ,কুঞ্জ সাজানি জাতীয় গানও কোনো কোনো অঞ্চলের শিল্পীরা গেয়ে থাকেন।

হালতি গান পরিবেশনের সময়:

বিশেষ করে বর্ষায় যখন অথৈ পানি থাকতো তখনই এসব গানের আসর বেশি বসত। দিন ক্ষণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকলেও প্রায়শই বৃহস্পতিবার রাতেই এই গানের আসর বসতো।যে কোনো উৎসবে আনন্দ আয়োজন হিসেবে এই গান পরিবেশিত হত।ভক্তপ্রবর বা মুরিদ কারো বাড়িতে পির মুর্শিদের আগমন ঘটলে বা এক রাতের জন্য একত্রে থাকলে ওই বাড়িতে হালতি গানের আসর বসতো।আবার কখনো কখনো গ্রামের কেউ নতুন ঘর বাড়ি তৈরী করলে মাহফিলে এই গানের আয়োজন করতেন।অনেকে এই গানের আসরে শিরনি বিতরণ করা হত।

হালতি গানের শ্রোতা:

এই হালতি গানের আসরের বেশিরভাগ শ্রোতা হতেন গ্রামের বয়স্ক আর আধা বয়স্ক পুরুষেরা।অবশ্য কিছু এলাকায় বায়েতপ্রাপ্ত শিষ্য ও রসজ্ঞ ব্যক্তিরাও অংশ নিতেন।মূলত মারফতি পদ্ধতিতে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের আশায় গ্রামীণ মানুষজন হালতি গানের আসরে আসতেন।একেকটি আসরে ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ অংশ নিতেন।ভক্ত,পির,মুরিদ,পিরভাইসহ নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে আসরে অংশ নিয়ে জিকির-আসকার করতেন,পির-মুর্শিদি গান গাইতেন।লাউ,ঢপকি,একতারা বাজিয়ে এ জিকির-আসকার চলত।

কোন গান গুলো কে হালতি গান বলা হয়,

১.বন্ধু তোর লাইগারে আমার তনু জর জর মনে লয় চলিয়া যাইতাম ছাড়িয়া বাড়িঘর।

২.আমার মালিক মৌলানা আমার খালিক মৌলানা আমারে বানাইয়া দাও কাবার দেওয়ানা।

৩.আমার মুর্শিদ পরশমণি গো, লোহারে বানাইলায় কাঞ্চা সোনা, মুর্শিদ রতন অমূল্য ধন, জীবন থাকতে চিনলাম না।

৪.বল গো বল গো সই,কোন বা দেশে যাই, কোনবা দেশে গেলে পাইমু শ্যামনাগর কানাই।

৫.দম গেলে দিন আর পাবেনা মুর্শিদের কথা শুন, মিথ্যাবাদীর সঙ্গ নিয়া কাজে কাজে হলে খুন। ……………………………….. গূঢ়তত্ত্ব গুপ্তবাজার না গেলে কি পাবে নিস্তার, আব্দুল লতিফে কয়,নোটিশ জারি সুবুলি ‘কুন ফাইয়া কুন’।

৬.প্রেম পাথরে যে সাঁতারে তার শরমের ভয় কি আছে ঘৃণা লজ্জা ভয় শঙ্কা জাতি কুলমান সব দিয়াছে।

৭.আমি যে মরি বন্ধুরে তুমিনি চক্ষে দেখো আমি মইলে সোনাবন্ধু কতই সুখে থাকো রে। ………………………………………………. সৈয়দ ইজহারে বলেরে বন্ধু চরণ ধইরে থাকি, ভুবনমোহন রূপটি তোমার মরতে যেন দেখি রে।

৮.আদমের কালেবের মাঝে পাক এলাহির বারামখানা দিবানিশি করছে খেলা খোদে খোদা পাক রাব্বানা। দেহের পিঞ্জরের মাঝে কি আজব কারখানা।

৯.ও নাও বাইলাম রে জীবন ভরিয়া নাও বাইলাম সাড়ে তিন হাত নাও লইয়া ভবের হাটে আইলাম।

১০.মন রে- সাত সমুদ্র তেরো নদী এই ঘরেতে আছে আকাশ জমি বেহেশত দোজখ ভিতরে রহিয়াছে বেহেশত দোজখের কাছে শ্রীকুলার বাজার সে বাজারে বসত করে ঘরের জমিদার ও মন,ঘর বানাইলো রে।

এছাড়াও অসংখ্য হালতি গান রয়েছে। শহুরে জনসমাজে লোক গানগুলোর বিচিত্র ধারা খুব একটা পরিচিতি না পেলেও এসব গানে গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্বের সংযোগ ঘটাতে পারবেন অনায়াসে।

লিখেছেনঃ রাফিয়া ইসলাম ভাবনা

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।