সেলেব্রিটির আড়ালে বিনষ্ট শৈশব

 সেলেব্রিটির আড়ালে বিনষ্ট শৈশব

বর্তমানে টিভি, ম্যাগাজিন বা কোন স্মার্ট স্কিনের পর্দায় চোখ বুলালে যে হারে ছোট শিশুদের ব্যস্তময় জীবন দেখি কয়েক বছর আগেও এতটা বহুলতা ছিলো না। বেশিরভাগেরই বয়স  সাত থেকে পনেরো বছর।পর্দার আড়ালে আমরা ভাবি, এত অল্প বয়সেই রোজগারের উপায় নির্ধারণ হওয়া মানেই তাদের রয়েছে সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ!

কিন্তু এপারে একজন দর্শক হিসেবে বেশিরভাগ সময়ই চিন্তা করিনা আদৌ তারা কি ভালো আছে! সত্যিই কি তাদের জীবনে কোন অভিলাষ, কোন যন্ত্রণা নেই! বাস্তব চিত্র আসলে উল্টো, শৈশব হারানোর যন্ত্রণা তাদেরকে যেমন বাবা মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করছে ঠিক তেমনি তাদের জীবনে নেমে এসেছে অবমাননাকর সব পরিস্থিতি।

বিখ্যাতের ভুল সংজ্ঞা

ইউটিউব, ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে আজকাল ছোট্ট শিশুরা তাদের কোন অঙ্গভঙ্গি, সুন্দর মুখশ্রীর আদলে যেভাবে সহজেই খ্যাতি পেয়ে যাচ্ছে, তাতে তাদের মনে হয়ে থাকে নাম, যশ মানেই সহজ কিছু। কিন্তু আদৌ তা না। যদি আমরা আমাদের পেছনের স্টারগুলোকে দেখি, তাদের জীবনের সংলাপগুলো পড়ি তবে আমরা দেখতে পাবো, তাদের জীবনে খ্যাতির ছোঁয়ার রেশ কতটা কষ্টলভ্য।

শৈশবের অভিজ্ঞতার অপূর্ণতা

জন্ম থেকে তিন কি চার বছর পর্যন্ত সময়গুলো কেটে যায় বাবা মার কাছে। তারপর শুরু হয় সামাজিকতার মাধ্যমে শৈশবের নানা রূপ, কৌতূহলের সাথে পরিচিতি। যখন একটা শিশু স্টার হয়ে যায়, তখন তার জীবনের ঘড়ির কাটাগুলো সম্পূর্ণ তার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে দর্শকের হাতে পড়ে যায়।

ম্যারি কেট অলসেন আমেরিকার বিখ্যাত অভিনেত্রী ছোট থেকেই ক্যামেরা, অ্যাকশন এক কথায় বিনোদন জগতের মাঝে বড় হতে থাকেন। তার হাস্যজ্জ্বল অবয়ব দেখে আমরা ভাবি সে কতটা পরিপূর্ণ। অটোগ্রাফ, ফ্লাশলাইটের মাঝে সুন্দর জীবন। কিন্তু তিনি ” ম্যারি ক্লেয়ার” ম্যাগাজিনে বলেন,

“আমি কখনোই চাইতাম না আমার জীবনের দিনানিপাত অন্য কেউ নির্ধারণ করে দিবে।”

ম্যারি কেট অলসেন

আরেক  অভিনেত্রী ব্যারিমর তার শৈশবের প্রতি আক্ষেপ করে বলেন, ” সাত বছর বয়সেই আমার আচরণ ছিলো একজন ২৯ বছর মহিলার মতো।” ভাবুন তো তাদের মতো আমাদের চারপাশে এমন কত শিশু স্টার রয়েছে, যেখানে তারা নিজেদের মতো করে শৈশবের আনন্দ, ইচ্ছে, সরলতা থেকে বঞ্চিত।

যেখানে যাবে লাপ-ঝাপ তো দূরে থাক, দর্শকের ভিড়ে সেটাও ভুলে বসে। তাদের কোন দিন শেষ হয় বা  কোন সকাল শুরু হয় সাক্ষাৎ দিয়ে, সকালের বা রাতের  রূপ দেখে নয়। ছোট্ট মনকে তখন বড়দের চাহিদার তাল মেলাতে হয়।

বাবা- মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত

বেশিরভাগ সময়ই সাক্ষাৎকার, কোন নাটক বা বিজ্ঞাপন নিয়ে সময়গুলো কেটে যায়৷ ট্যাব, স্মার্টফোনে দর্শকদের সাথে ভিডিও আলাপে এবং ১০ বছর বয়স থেকে কমেন্ট, চ্যাটিং এ দিন থেকে কখন রাত হয় টেরই পাওয়া যায়না। বাবা মার আদর, তাদের কাছে আহ্লাদীপনা আর করা হয়না। মায়ের পরশ, রূপকথার গল্পও আর শোনা হয়ে উঠেনা।

বাবা মাও খ্যাতির লোভে সন্তানকে সবসময় স্টার লাইফের জন্য তাড়া দেন। সন্তানের মনের খবর জানার থেকে বর্হিজগতে তাদের পরিচিতিকে আরো দৃঢ় করতে উঠে পড়ে লাগেন। মার হাতে করা খাবারের গন্ধ নেওয়ার থেকে মেকআপের মিশ্রণে মিশে যেতে হয়। কেউ কেউ সরে আসতে চাইলেও বাবা মায়েরা তাদেরকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মানসিক শান্তির থেকে জীবনে অর্থ, প্রবৃত্তিই সব।

ব্যর্থতাকে মেনে নিতে না পারা

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন কোন পরিপূর্ণতায় পৌঁছান তখন তার জীবনে ব্যর্থতা আসলেও সে সেটাকে যেভাবে সামাল দিতে পারে, সেভাবে একজন অল্পবয়সী ছেলে বা মেয়ে তা পারেনা। তার জীবনে তখন নানা মানসিক রোগের অনুপ্রবেশ ঘটে। একজন স্টার যে সবসময় দর্শকদের মানিয়ে চলতে ব্যর্থ হয় সেটা সে বুঝতে পারেনা। বিদেশী কিছু ম্যাগাজিনে কিছু স্টারের ভয়ংকর রোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়ার কারণে জীবন নষ্ট হওয়ার খবর জানা গিয়েছে। আবার অ্যাকশন সিনগুলোতে সফল না হওয়ার কারণে বিকলাঙ্গ হওয়ার গল্পও কম নয়।

ড্রাগের অনুপ্রবেশ

মিডিয়াতে এমন ও খবর পাওয়া গেছে সাত বছরের ছেলে বা মেয়েও ইয়াবা,  হিরোইন নেওয়া শুরু করে ব্যর্থতা বা সঙ্গ দোষের কারণে। ছোট থেকেই নাইট ক্লাবের সাথে জড়িয়ে পড়ার ফলে পানীয়ের জগতে ছোটকাল থেকে প্রবেশ ঘটে। এইসবকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে নেওয়ার জন্য শরীরেও নানা ধরনের শারীরিক অসুখ ও পরিবর্তন ঘটে।

অবমাননাকর পরিস্থিতি

ইদানীং মিডিয়াতে সেক্সুয়াল রিলেশনশিপের খবর প্রায়ই শোনা যায়। একবার ভাবুন তো ব্যাপারটা কতটা ভয়ংকর, যে টিনএজ বয়সেই একজনকে কোন রোল পাওয়ার জন্য পরিচালকের অবৈধ চাহিদাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। টিনএজ বয়সেই তাকে তার আপত্তিকর ছবি ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

শৈশবের দিনগুলো হওয়া উচিত শৈশবের মতো। কিন্তু আজকের শিশুরা তাদের এই বিনষ্ট জীবনে প্রিয়জনকেও বন্ধুর মতো পাশে না পেয়ে জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে আঁধারকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দেশ – বিদেশের শিশুদের অনুষ্ঠানগুলোতে যদি সর্তকতার সাথে খেয়াল করি তবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবো কত অল্প বয়সেই তাদেরকে কত জটিল পারফরম্যান্সের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। যেখানে বাধাহীন না এর বদলে পারিপার্শ্বিক চাপে নিশ্চুপ বা আক্ষেপের হ্যাঁ কে মেনে নিতে হচ্ছে ।

লিখেছেনঃ সামিহা আতিকা

RedLive

Related post