জীবপ্রযুক্তির অবদান: টিস্যুকালচার

 জীবপ্রযুক্তির অবদান: টিস্যুকালচার

সভ্যতার উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমশ উন্নত হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। প্রযুক্তি বলতে কেবলই মোবাইল ফোনের নানাবিধ ব্যবহার,ইন্টারনেট,কম্পিউটার,যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা নয়,বরং প্রযুক্তি বিস্তৃত, আধুনিক এবং প্রয়োগমুখী একটি বিষয়। তেমনি জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রযুক্তিকে বলা হয় জীবপ্রযুক্তি তথা বায়োটেকনোলজি। এই জীবপ্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত একটি শাখাই হলো টিস্যুকালচার।

জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology) কি?

উইকিপিডিয়া এর মতে,জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology) হলো বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে জীবদের ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর ও ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় মালামাল তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি। আজ থেকে বহু বছর আগে ১৯১৯ সালে হাঙ্গেরীয় কৃষি প্রকৌশলী কাল এরেকি সর্বপ্রথম Biotechnology শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। জীবপ্রযুক্তির পরিধির ক্রমশ সম্প্রসারণ হচ্ছে। বর্তমানে জীবপ্রযুক্তির পরিধি ব্যাখা করার জন্য গোল্ড টেকনোলজি, ব্লু টেকনোলজি ( জলীয় ও সামুদ্রিক), গ্রিন টেকনোলজি ( কৃষিক্ষেত্রে) এবং রেড ও হোয়াইট টেকনোলজি (চিকিৎসাক্ষেত্রে) শব্দগুলো বহুল প্রচলিত। জিন প্রযুক্তি,এনজাইম প্রযুক্তি,কীট-পতঙ্গ প্রতিরোধী উদ্ভিদ উৎপাদন,ইনসুলিন ও ইন্টারফেরন উৎপাদনসহ আরো নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে জীবপ্রযুক্তি।

টিস্যুকালচার হলো জীবপ্রযুক্তির একটি নতুন এবং ক্রমশ বর্ধমান একটি শাখা। টিস্যুকালচারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন জাতের উদ্ভিদ উৎপাদন,রোগমুক্ত উদ্ভিদ উৎপাদন এবং বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের রক্ষা,শিল্পক্ষেত্রে ও উদ্ভিদের প্রজননক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে টিস্যুকালচার প্রযুক্তি বিশেষ অবদান রাখছে।

টিস্যু এবং টিস্যুকালচার কি?

টিস্যু হলো উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে একই উৎস হতে সৃষ্টি হওয়া এবং একই ধরনের কাজ সম্পাদনকারী অবিচ্ছিন্ন কোষগুচ্ছ। আর টিস্যুকালচার হলো উদ্ভিদের বিভাজন ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন টিস্যু বা টিস্যুগুচ্ছকে জীবানুমুক্ত অবস্থায় উপযুক্ত পুষ্টি মাধ্যমে বৃদ্ধিকরণ এবং পূর্ণাঙ্গ চারা সৃষ্টির একটি প্রক্রিয়া।
জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী Gottlieb Haberlandt কে বলা হয় টিস্যু কালচারের জনক।

টিস্যুকালচার প্রক্রিয়া

টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো সম্পূর্ন জীবাণুমুক্ত পরিবেশ। আবাদ মাধ্যম বা কালচার মিডিয়াম কোনোভাবে সংক্রমণের শিকার হলে,সেই মিডিয়াম আর ব্যবহার করা যায় না। তাই প্রয়োজনীয় পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আবাদ মাধ্যমকে সম্পূর্ণ নির্বীজ করে নিতে হয়। টিস্যু কালচারে প্রধানত উদ্ভিদের শীর্ষমুকুল,কক্ষমুকুল,কচি পাতা,পরাগধানী ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। কিছু ধাপ অনুসরণের মাধ্যমে টিস্যু কালচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

প্রক্রিয়ার শুরুতে সুস্থ,নিরোগ এবং ভালো মানের মাতৃউদ্ভিদ সংগ্রহ করে এর থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। এরপরই প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মিশিয়ে আবাদ মাধ্যম তৈরী করে নিতে হয়। পুষ্টি উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন,ফাইটোহরমোন,সুক্রোজ ইত্যাদি।এ পাত্রে pH এর মান থাকতে হবে ৫.৫ থেকে ৫.৮ এর মধ্যে। অটোক্লেভ যন্ত্রের মাধ্যমে মিডিয়ামকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করে নিতে হয়। এরপর পরবর্তীতে আবাদ মাধ্যমে সংগৃহীত টিস্যু স্থাপন করতে হয়। টিস্যু স্থাপনের পর পাত্রটিকে নিদির্ষ্ট মাত্রার আলো,তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আদ্রর্তা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়। দিনকয়েক বাদে টিস্যুটি বারবার বিভাজিত হয়ে ক্যালাস আকার ধারণ করে। ক্যালাস হলো অবয়বহীন অবিন্যস্ত টিস্যুর গুচ্ছ। ক্যালাস থেকে মুকুল সৃষ্টির মাধ্যমে চারা উৎপাদন হয়।

ক্যালাস সৃষ্টির পরবর্তী পর্যায়ে খুব সাবধানতার সাথে মুকুলকে কেটে নিয়ে মূল উৎপাদনকারী মিডিয়ামে রাখা হয় এবং প্রতিটি মুকুল ক্রমশ মূল সৃষ্টির মাধ্যমে চারায় পরিণত হয়। মূল সুগঠিত হওয়ার পর চারা গুলোকে টবে স্থানান্তর করা হয়। টবগুলোকে আর্দ্রতাসম্পন্ন স্থানে রাখা হয়। তবে মাঝে মাঝে এগুলোকে রোদে রেখে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।

বাংলাদেশে টিস্যু কালচার পদ্ধতির ব্যবহার

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে আশির দশকের প্রথম দিকে টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এ কাজ সম্প্রসারিত হয়েছে।

বাংলাদেশে টিস্যু কালচার প্রক্রিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধক্ষম কলার চারা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এছাড়া শীতপ্রধান দেশের স্ট্রবেরি ফলের গাছকে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করে মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে আবাদকরণ সম্ভব হয়েছে। কদম,জারুল,ইপিল ইপিল,বক ফুল,মেহগনি,কেলিকদম প্রভৃতি কাঠ উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চারা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। রোগমুক্ত আলুর মাইক্রোটিউবার অর্থাৎ আলুবীজ উৎপাদন এবং তা মাঠপর্যায়ে বিপণন সম্ভব হয়েছে। পাটের ভ্রুণ কালচার ও চারা উৎপাদনে টিস্যুকালচার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া দেশি-বিদেশি নানা অর্কিডের এবং বিদেশি ফুলের চাষ করা সম্ভবপর হয়েছে একমাত্র টিস্যু কালচারের প্রসারতার কারণে৷ বলা যায় বাংলাদেশের কৃষিখাতে টিস্যু কালচারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

টিস্যু কালচারের অসুবিধাসমূহঃ

স্বল্প সময়ে বহু রোগমুক্ত এবং উৎপাদনক্ষম চারা সৃষ্টি এবং বিভিন্ন জাতের প্রকরণে টিস্যু কালচারের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা বা অসুবিধাও রয়েছে।

টিস্যু কালচার প্রযুক্তির প্রধান সমস্যা হলো এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশ মূল্যমান কিছু যন্ত্রপাতি ( অটোক্লেভ,ল্যামিনার ফ্লো) এবং রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এগুলো মূল্যবান হলেও অনেক ক্ষেত্রে এগুলো খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রাথমিক অবস্থায় থাকাকালীন আবাদ মাধ্যম যদি কোনোভাবে আক্রান্ত হয়,তবে অসংখ্য সম্ভবনাময় চারার বিনাশ ঘটে। টিস্যু কালচার প্রক্রিয়া কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী এবং চারাগুলো খুব ক্ষুদ্রাকৃতির হওয়ায় এদের স্থানান্তর করা বেশ অসুবিধার সৃষ্টি করে। এছাড়াও টিস্যু কালচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য দক্ষ জনবলের প্রয়োজন পড়ে যা সবসময় পাওয়া যায় না।

টিস্যুকালচার অপেক্ষাকৃত নতুন শাখা হলেও এটি বেশ ফলপ্রসূ এবং প্রয়োজনীয় একটি শাখা। শুধু বাংলাদেশের কৃষিখাতে নয়,বিশ্ব অর্থনীতিতেও টিস্যুকালচার প্রক্রিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই শাখায় নতুন সম্ভবনার সৃষ্টি হবে এবং এর পরিধি আরো বিস্তৃত হবে যা মানব কল্যাণে এবং কৃষিক্ষেত্র সহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে জ্বালাবে নতুন আশার আলো।

লিখেছেনঃ অংকিতা দাশ

RedLive

Related post