অনলাইন বিজনেসে পণ্যের দাম কিভাবে নির্ধারণ করবেন?

 অনলাইন বিজনেসে পণ্যের দাম কিভাবে নির্ধারণ করবেন?

বর্তমানে ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যে পেশাটি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সেটি হলো ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা। অনলাইনে ক্রেতারা নিজেদের পছন্দমতো জিনিস বেছে নেন এবং বিক্রেতার দেওয়া নির্ধারিত দামে সেটি কিনে থাকেন। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি একজন ক্রেতাকে কোনো পণ্য কেনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী করে তুলতে পারে সেটি হলো পণ্যের দাম অর্থ্যাৎ প্রোডাক্ট প্রাইসিং। অনলাইনে বিক্রয়ের জন্য যেকোনো পণ্যের দাম কিভাবে আর্কষণীয় হতে পারে সে বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হল।

• কেন প্রয়োজন সঠিক মূল্য নির্ধারণ?

হুজুগের বশে কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক বর্তমানে অনেকেই অনলাইন ব্যবসায়ের দিকে বেশ আগ্রহী হলেও এর মধ্যে অনেকেই পরিপূর্ণ ব্যবসায়িক ধারণা রাখেন না। যার ফলে হুটহাট ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং পণ্যের যাবতীয় খরচ এবং সব দিক বিবেচনা না করেই মনমতো পণ্যের দাম নির্ধারণ করে থাকেন। মনমতো পণ্যের দাম নির্ধারণ করার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো সব ধরনের খরচ পণ্যের দামের সাথে যুক্ত হয় না। ফলে দেখা যায় ব্যবসা পরিচালনার খরচটুকুই উঠে আসছে না। পরবর্তীতে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হন।

বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমরা খুব সহজেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার পেইজ কিংবা ই-কমার্স ওয়েবসাইটে পেয়ে থাকি। দেখা যায়,একই পণ্যের দাম একেক জায়গায় একেক রকম। এক্ষেত্রে ক্রেতা নায্যমূল্যে গুণগতমানসম্পন্ন পণ্যটি বেছে নেন। তাই বিক্রেতার উচিত যেকোনো পণ্যের গুণগতমান ঠিক রেখে এবং উৎপাদন ও বিপণন খরচ হিসাব করেই পণ্যটি নায্যমূল্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া,যাতে করে ক্রেতার কাছে পণ্যটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।

• কিভাবে দাম নির্ধারণ করা যায়?

পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিবেচ্য বিষয়টি হলো পণ্যটির উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে এবং বিপণনে কতটা শ্রম এবং অর্থ ব্যয় হয়েছে,সেই বিষয়টি। এক্ষেত্রে পণ্যের কাচাঁমাল কিভাবে সরবরাহ করা হবে,সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দুই উপায়ে পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রথমত,নিজের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শিল্প তৈরী করে এবং দ্বিতীয়ত, কোনো হোলসেইলার বা পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে। যদি আপনার কাছে নিজস্ব সৃষ্টিশীল ধারণা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকে তবে অবশ্যই পণ্য নিজে তৈরী করাই শ্রেয়। এর মধ্যে ঘর সাজানোর জিনিস, হ্যান্ডপেইন্টেড ব্যাগ,জামা,জুতা,গয়না কিংবা অন্যান্য শৌখিন জিনিসপত্রাদি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো হবে কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে ব্যয়, শ্রমিকের এবং শ্রমের পারিশ্রমিক ও পরিবহন খরচ।
অপরদিকে, পাইকারি ব্যবসায়ী কিংবা হোলসেলারদের থেকে আপনি প্রয়োজনমত যেকোন ধরনের গুণগতমানসম্পন্ন পণ্য কিনে নিতে পারেন। এজন্য বেছে নিতে পারেন ইলেকট্রনিক সামগ্রী,বিদেশী জুতা,ব্যাগ,জামা-কাপড়,জুয়েলারী সামগ্রী ইত্যাদি। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণের বিবেচ্য বিষয়গুলো হল: পণ্য পাইকারি মূল্য,মজুদের খরচ এবং পরিবহন খরচ।

পণ্যের সরবরাহ এর বিষয়টি নিশ্চিত করার পর যে কাজটি সবচেয়ে মজার সেটি হলো পণ্যের দাম নির্ধারণ করা। পণ্যের আকর্ষণীয় দাম আপনাকে মার্কেটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং লাভজনক অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করতে সাহায্য করবে। দামের পাশাপাশি পণ্যের গুণগতমানের দিকে লক্ষ্য রাখাও অত্যন্ত প্রয়োজন।

প্রথম ধাপঃ পণ্য বিক্রয়ের পূর্বে পণ্যের যাবতীয় খরচ যেমনঃ পণ্যের উৎপাদন খরচ,বিপণন খরচ,প্যাকেজিং ব্যয়,পরিবহন খরচ ইত্যাদি হিসাব করে নেওয়া উচিত।

ধরুন, আপনি যেকোনো একটি কার্টুন এর সুন্দর হ্যান্ডপেইন্ট করা টি-শার্ট বিক্রয় করতে চাইছেন।

-প্রত্যেকটি টি-শার্ট এর দামঃ ১০০-১৫০ টাকা,এক্ষেত্রে টি-শার্টের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হলে দাম টা কমে আসতে পারে।

  • প্রত্যেকটি টি-শার্টের বিক্রির পিছনে ইনভেন্টরি, লজিস্টিকস, ম্যানপাওয়ার খরচঃ ১০০ টাকা

-ডিজাইন এবং পেইন্টিং ব্যয়ঃ ৫০ টাকা

-প্রত্যেকটি টি-শার্ট বিক্রয়ের জন্য মার্কেটিং খরচঃ ১০০ টাকা

-প্যাকেজিং খরচঃ ১০ টাকা

এক্ষেত্রে,মোট ব্যয়ের পরিমাণ (১৫০+১০০+৫০+১০০+১০) টাকা
=৪১০ টাকা।

দ্বিতীয় ধাপঃ এখন আসা যাক লাভের ব্যাপারটিতে। এজন্য আপনার ব্যবসার কাঙ্খিত লাভের পরিমাণ নির্ধারণ করুন। এক্ষেত্রে আপনি কতসংখ্যক টি-শার্ট বিক্রি করবেন,এটি কি আপনার এককালীন ব্যবসা নাকি স্থায়ী ব্যবসা,আপনি বাজারের চলতি প্রতিযোগিতাকে হার মানাতে কত কম দামে বিক্রি করতে পারবেন,আপনার লক্ষ্য বেশি লাভে কম বিক্রি নাকি কম লাভে বেশি বিক্রি এসমস্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘কম লাভে বেশি বিক্রি’ এই নীতি মেনে চলাই শ্রেয়।

ধরুন,আপনি প্রত্যেক টি-শার্টে ২০% লাভ করতে চাইছেন, এক্ষেত্রে (৪১০+৮২) টাকা = ৪৯২ টাকা~৫০০ টাকা যা বর্তমান বাজারের চলতি দামের সাথে যথেষ্টই প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ। আপনি চাইলে আপনার প্রফিট মার্জিন কিছুটা কমিয়ে কিংবা বাড়িয়ে নিতে পারেন। পণ্যের সাথে ডেলিভারি কস্ট ও যুক্ত করা আছে,সেজন্য আপনি চাইলে ফ্রি ডেলিভারি সুবিধা রাখতে পারেন। এছাড়া আপনার ব্যয় কমাতে চাইলে কোন কোন দিকে ব্যয় কমানো যায়,সে ব্যাপারে একটু ভাবনা-চিন্তা করে রাখতে পারেন।এসব কিছুই আপনার পরিকল্পনারই অংশ।

• অন্যান্য প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ঃ

১) ওভারপ্রাইসিংঃ ওভারপ্রাইসিং আপনার পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে ফেলবে। অতিরিক্ত দাম কখনোই আপনার সেলস বৃদ্ধি করবে না,বরং ক্ষতির সম্মুখীন হবে আপনার ব্যবসা।

২) আন্ডারপ্রাইসিংঃ ওভারপ্রাইসিং যেমন সমস্যার কারণ হতে পারে,তেমনি আপনার পণ্যের কম মূল্য ও ব্র্যান্ডিং এর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। ক্রেতাদের মনে আপনার পণ্য নিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

৩) ভ্যালু এডেড সার্ভিসঃ কোনো ক্রেতা যখন পণ্য ক্রয় করে,তখন তিনি কেবল পন্যই কেনেন না,সাথে কিছু অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয় করেন যা আপনার পণ্যের কিংবা কোম্পানির ব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে পণ্যের সাথে বিশেষ প্যাকেজিং সুবিধা কিংবা ফ্রি রিটার্ন পলিসি যুক্ত করতে পারেন। আপনি এমন বিশেষ কিছু অফার করছেন,যা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা করছে না,এর জন্যে ও আপনি চার্জ করতে পারেন।

অফলাইন কিংবা অনলাইন; যেকোন ধরনের ব্যবসায় পণ্যের সোর্সিং পাকাপোক্ত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রোডাক্ট সোর্সিং পাকাপোক্ত না হলে এবং সঠিক প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ মূল্যে পণ্য ক্রয়বিক্রয় করতে না পারলে লাভের মুখ দেখা যথেষ্ট কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে। তাই সব দিক বিবেচনা করেই ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এবং পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা উচিত যাতে আপনার ব্যবসা অকালেই তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙ্গে না যায়।

লিখেছেনঃ অংকিতা দাশ

RedLive

Related post