বিশ্ববিখ্যাত মনীষীদের দর্শন থেকে শিক্ষা

 বিশ্ববিখ্যাত মনীষীদের দর্শন থেকে শিক্ষা

শিক্ষা শব্দটির অর্থ হল বিদ্যা লাভ, জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান অর্জন বা বিকাশ সাধন। শিক্ষা কে মূলত জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করা হয়। শিক্ষা হল যর্থাথ নির্দেশনা এবং পরিচর্যার মাধ্যমে পরিচালিত কর্মকান্ড যা শিক্ষার্থীদের পূর্নাঙ্গ বিকাশ প্রক্রিয়ার সমন্বয়। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। মানসভ্যতার উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এসেছে পরিবর্তন। বিভিন্ন দেশের দার্শনিকগণ শিক্ষাব্যবস্থার সংগঠনে ও শিক্ষাক্রমে যথোপযুক্ত কৌশলের পথ অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই পর্যায়ে কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, যেমনঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বারট্রান্ড রাসেল, সক্রেটিস এর শিক্ষা ভাবনা নিয়ে জানবো। যাদের শিক্ষা দর্শন শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথাটি শুনলেই বাঙালির অতি আপন, কাছের মানুষ মনে হয়। বাংলা সাহিত্যে যার অবদান চিরকাল নক্ষত্রের উজ্জ্বল দ্যুতির ন্যায় প্রবাহমান থাকবে। তাঁর সাহিত্য কর্ম ছিল মানবতাবাদ ও অধ্যাত্মদর্শনে সমৃদ্ধ। মানব জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে তার সাহিত্যের ছোঁয়া নেই। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা নিয়ে কি ভাবনা ছিল, কেমন ছিল তাঁর শিক্ষা দর্শন?

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনে তাঁর জীবনবোধের দর্শনেরও প্রতিফলন ঘটেছে। ছোটবেলা থেকেই তার বিদ্যালয়ের প্রথাগত ও অনাকর্ষনীয় পরিবেশের প্রতি অনীহা ছিল। তিনি ছিলেম মুক্ত চিন্তার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রকৃত মানুষ তৈরি করাই হবে শিক্ষার লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ জীবনের পূর্ণ বিকাশ এবং দেহ, মন ও আত্মার পরিপূর্ণ মুক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষাক্রম প্রণয়নেত কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বিদ্যালয় এমন একটি পৃথক ব্যবস্থা নয় যেখানে শিশু যান্ত্রিকভাবে পাঠ অনুশীলন করবে। শিশুর শিক্ষার পরিবেশ এমন হবে যেখামে তার আগ্রহের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে। তার প্রতিষ্ঠিত ‘শান্তিনিকেতন’ ‘শ্রীনিকেতন’ এমনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। সেখানে শিক্ষার্থীর আপন কাজে সম্পৃক্ত থেকে মানসিক, নৈতিক, সামাজিক ও অধ্যাত্মিক গুণাবলী অর্জন করতো।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেম উচ্চ মননশীলতার পরিচায়ক। তিনি উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে যুবসমাজকে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সহায়তার পাশাপাশি প্রত্যেকর মধ্যে সেই গুন জাগরিত করতে চেয়েছিলেন যা পৃথিবীর সকল মানুষকে আপন করে নিবে। তার শিক্ষা চিন্তাকে বাস্তবে রুপদানের জন্য তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হতে পারবে চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ।

রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার মিলন’, ‘শিক্ষার হেরফের ‘, ‘তোতাকাহিনী’, ‘শিক্ষা সমস্যা’ প্রভৃতি গ্রন্থে ও প্রবন্ধে প্রচলিত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।

সুতরাং, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন পর্যালোচনা করে বলা যায়, শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ব মানবতাবোধ এর উন্মেষ ও বিকাশ সাধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। যে শিক্ষাভাবনা ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যাবস্থার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কেরানী বা দক্ষ শ্রমিক তৈরীর বিপরীতে ‘পূর্ণ মানুষ’ তৈরীর ‘জ্ঞানের উৎপাদনের’ একটি প্রক্রিয়া।

বারট্রান্ড রাসেল এর দর্শন

নোবেল বিজয়ী বারট্রান্ড রাসেল ছিলেন একজন দার্শনিক, গণিতজ্ঞ এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তার শিক্ষা দর্শন ‘On Education ‘, Education and the social order এই দুটি বই তে বর্নিত আছে। তাঁর শিক্ষা দর্শন মূলত তার নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষাদানকে কেন্দ্র করে চিন্তা-ভাবনার ফসল। তিনি তাঁর স্ত্রী ডোরা ব্ল্যাক কে নিয়ে ১৯২৭-১৯৩৪ পর্যন্ত Beacon Hill School পরিচালনা করেন। মূলত, তাঁর শিক্ষা ভাবনা ছিল বিভিন্ন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ফসল।

শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারনে গুণাবলি ও দক্ষতার উপর জোর দিয়েছেন। রাসেলের মতে,শিক্ষার উদ্দেশ্য চারটি গুণ আয়ত্ত্ব করা। তিনি বলেন– ”যে চারটি বৈশিষ্ট্য সম্মিলিতভাবে আদর্শ চরিত্রের ভিত্তি রচনা করতে পারে সেগুলো হলো: উদ্যম, সাহস, সংবেদশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তা। ”

বারট্রান্ড রাসেল শিশুদের শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে শিশুর শিক্ষা জন্মের পর শুরু হতে হবে। প্রথমে, শিশুর চরিত্র গঠন ও জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দিতে হবে। শিক্ষা শিশুর অনুভূত চাহিদা ও সমাজের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। তিনি তার ‘Freedom in Education ‘ প্রবন্ধে শিশুদের শিক্ষার সময় তাদেরকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেবের পক্ষে মত দিয়েছেন। সেখানে শিশুদের শেখা ও মত প্রকাশকে সুপষ্ঠ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

সক্রেটিস এর দর্শন

সক্রেটিস কে দর্শন শাস্ত্রের গুরু বলা হলেও শিক্ষাকাশে চিরভাস্বর, উজ্জ্বল এর জোত্যিষ্ক। তিনি দর্শন শাস্ত্রে সর্বপ্রথম বলেছিলেন Know Thyself অর্থাৎ “নিজেকে জানো”। সক্রেটিস কে বলা হতো ভাববাদী শিক্ষা দার্শনিক। সার্বিক জ্ঞান অর্জন করা তার শিক্ষা দর্শনের মূল কথা। তিনি মনে করতেন, জ্ঞানের প্রধান উৎস প্রজ্ঞা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মাঝে সুপ্ত ক্ষমতার বা সামর্থ্যের বিকাশ, জ্ঞানের পরিবর্তন ও উন্নয়ন।

সক্রেটিস যুবসমাজকে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতেন। যুক্তির সাহায্যে তিনি প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং নতুন প্রশ্নের অবতারণা করতেন। তিনি মানুষের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিতেন না বরং সার্বিক বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টিতে সাহায্য করতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের দিকে বেশি খেয়াল রাখতেন।

নিঃসন্দেহে, শিক্ষার মধ্যে রয়েছে অভিনবত্বের স্বাদ, নতুনত্বের নির্যাস, জীবনোন্নয়নের স্বতঃস্ফর্ততা। যুগে যুগে মানব সভ্যতার ক্রমোন্নয়ে যত মনীষীদের আগমন ঘটবে, তাদের শিক্ষাভাবনা শিক্ষা কে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।

লিখেছেনঃ
বৃন্তি সাহা

ফিচার ইমেজঃ
ক্রিয়েটেড বাই হাসিন মাহতাব

All rights reserved by RED LIVE

RedLive

Related post