মুঘলদের সাজসজ্জা কেমন ছিল!

 মুঘলদের সাজসজ্জা কেমন ছিল!

ধরুন আপনার পরিচিত একজন বিয়ে করতে চলেছে।ঠিক এ সময় হই হই রব উঠল।আরে বর যে গাড়িতে উঠে গেল।বরের মাথার পাগড়ী কই?আবার ধরুন,ঠাঠা রোদে বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।কিন্তু এদিকে ক্রিকেট আপনাকে ডাকাডাকি করছে।উপায়ন্তর না দেখে নিজের ক্যাপটাই মাথায় পরে নিলেন।সেলোয়াড় কামিজ পরিহিতা আপনার বোন এই কান্ড দেখে দৌড়ে গেল আপনার মাকে নালিশ করতে।আচ্ছা কখনো কি মাথায় এসেছে,সৃষ্টির পর পরই তো নিশ্চয়ই এমন পোশাক ছিল না।তাহলে কীভাবে এল এই সকল পোশাক ও সাজ সরঞ্জাম।কারাই বা আনল আমাদের কাছে?কেমন ছিল এই সমস্ত পোশাকের আদিরূপ?আজকের লেখায় চলুন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসি।

উপমহাদেশীয় সাজসজ্জা ও ফ্যাশন যুগের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।সাথে রয়ে গেছে বিভিন্ন শাসনামলের ছাপ।তবে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও ফ্যাশনপ্রিয় মানুষজন সবসময়ই স্বীকার করেছেন,মুঘল আমলের ফ্যাশনের ধারনা,আমাদের উপমহাদেশীয় সাজসজ্জায় সবথেকে বেশি প্রভাব রেখে গেছে।আজকের সমৃদ্ধ টেক্সটাইলেও রয়েছে মুঘলদের অবদান।

মুঘল আমলের পোশাকের উপকরণঃ

১৬শ,১৭শ ও ১৮শ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে।১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সালের এই মোঘল সাম্রাজ্যের নবাব কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি পোশাক পরিচ্ছদেও ছিলেন খুবই আগ্রহী।তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ধরনের পোশাক পরার মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে।যদিও সাধারণ মানুষের পোশাকের সঙ্গে মোঘল বংশের পুরুষ কিংবা নারীদের পোশাকের আকাশ পাতাল পার্থক্য ছিল।

মুঘল সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞীরা খুবই উচ্চমানের কাপড়ের তৈরি নান্দনিক,ব্যয়বহুল এবং বিলাসী পোশাক পরিধান করত।এই পোশাক গুলো মূলত মসলিন,সিল্ক,ভেলভেট ও ব্রোকেডের তৈরি ছিল।রঙিন ঢেউ,ডট কিংবা চেকের মতো প্যাটার্ন বা ডিজাইন ব্যবহার করা হত পুরো পোশাক জুড়ে।এই সকল কাপড় মূলত কোহনিকাল(cochnical),আয়রনের সালফেট,এন্টিমনির সালফেট এবং কপারের সালফেট দিয়ে ডাইং করা হত।

মুঘল আমলের সাজসজ্জাঃ

মুঘল আমলের নবাব বংশ কিংবা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা যে ধরনের পোশাকের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের পরিচয় করিয়ে দেয়,তার অনেকটাই আজ কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পোশাকে ঠাঁই পেয়েছে।

জামা:

জামাগুলোকে ইয়াখতাহি (Yakhtahi)জামা বলা হত।এগুলো ছিল পুরুষের পরার জন্য।।জামাগুলো মূলত তৈরি হত পার্সিয়া ও মধ্য এশিয়ায়।পার্সিয়ান শব্দ ‘জামা’ অর্থ হল কোট,গাউন বা দড়ি।একপাশে দড়ি দিয়ে বাঁধা, আঁটসাঁট এই জামাগুলো সাধারণত ‘বাস্ট আগাগ(Bast Agag)’ নামক এক ধরনের পায়জামার উপর পরা হত।কেউ কেউ লম্বা জামা পরলেও বেশিরভাগই পরত হাঁটু পর্যন্ত।এই জামা থেকেই পুরুষের নাইট গাউন এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

ছোঘা(chogha):

সেসময়কার পার্সিয়ান বা মঙ্গলিয়ানদের ছবি দেখলে এক ধরনের কোটের মতো দেখা যায়,যা অনেক লম্বা ও নিচের দিকে পুরোটাই খোলা।এই কোটগুলো মূলত লম্বায় হাঁটু বা কোমরের কিছুটা নিচ পর্যন্ত হত।মুঘল আমলে ছোঘাকে আরো ঢিলাঢালা করে জামার ওপর পরা হত।নবাব বংশের পরিহিত ছোঘা বেশ কারুকার্যময় হত।তখন এটা পুরুষের পোশাক থাকলেও,বর্তমানে মেয়েদের ছোঘা পোষাক বেশ জনপ্রিয়।

পটকা/পাটকা(patka):

সিনেমা, নাটক কিংবা কার্টুনের কল্যানে আমাদের খুব পরিচিত একটা দৃশ্যের কথা বলি।যুদ্ধ চলছে।সেনাপতি তার কোমরবন্ধনী থেকে বের করে এনেছেন সুদৃশ্য এক তলোয়াড়।এই কোমরবন্ধনীকেই বলা হত পটকা বা পাটকা।এই বন্ধনী খুবই ভালো কাপড় দিয়ে এমনভাবে তৈরি হত,যেন কোমরে খুব সহজে তলোয়াড় শক্ত করে রাখা যায়,কিন্তু পরিধানকারী কোনো ব্যাথা না পায়।রাজবংশের লোকেদের জন্য তৈরি অনেক পটকা/পাটকাতে টেক্সটাইলের সর্বোচ্চ সুন্দর ব্যবহার দেখা যায়।অনেকের মতে,এই পটকা/পাটকা থেকেই আধুনিক বেল্টের ধারণা এসেছে।তবে এটি বিতর্কিত একটি মতামত।

পাগড়ী(turban):

তখনকার সময়ে পাগড়ী শুধু কোনো মাথায় পরিধানের বস্তুই ছিল না,ছিল পুরুষের গর্বও।প্রতিপক্ষের সামনে মাথা থেকে খুলে পাগড়ী নামিয়ে রাখা মানে ছিল আত্মসমর্পণ করা।এই পাগড়ীগুলো তৈরি হত দামী রত্ন দিয়ে।পাঞ্জাবীদের মধ্যে পাগড়ী পরার চল এখনো দেখা যায়,যদিও তা খুবই সাধারণ পাগড়ী।আমাদের দেশের অনেক বিয়েতেই বরের মাথায় পাগড়ী থাকে।

সেলোয়াড়:

এটি মূলত ত্রিকোনাকৃতির পায়জামা ছিল,যার গোড়ালির দিকে নরম কাপড় দিয়ে ব্যান্ডের মতো তৈরি করে দেয়া হত।পরবর্তীতে এই ধারণা থেকেই আধুনিক সেলোয়াড় তৈরি হয়।এছাডাও ‘ধিলজা’,’ফারশি’,’গাজারা’র মতো আরো অনেক ধরনের পায়জামা মুঘল আমলে প্রচলিত ছিল।

চুড়িদার:

দুইপাশে কাটা,গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা একধরনের পোশাক হল চুড়িদার।তবে কিছু কিছু চুড়িদারে দুপাশে কাটা থাকত না।তাকে আনারকলি বলা হত।তখনকার পুরুষ নারী উভয়ই চুড়িদার পরত।কিন্তু বর্তমানে চুড়িদার কিংবা আনারকলি মূলত মেয়েদের পোশাক।

ক্যাপ(cap):

তখনকার দিনের ক্যাপ থেকে যদি আজকের সাধারনের ক্যাপের ধারনা এসেছে,কিন্তু অই ক্যাপ ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন প্রকৃতির।ওইসকল ক্যাপ প্রচুর কারুকার্য সম্বলিত ও বিভিন্ন আকৃতিতে তৈরি হত। চার ধরনের ক্যাপের কথাই এক্ষেত্রে বেশি জানা যায়। কুব্বেদার(Qubbedar) যা ছিল গম্বুজ আকৃতির ক্যাপ। কাশি(Kashi)ছিল নৌকা আকৃতির ক্যাপ ডুপাল্লি(Dupalli) একপ্রকার সরু ও ছোট ক্যাপ নুক্কা দার(Nukka Dar) ছিল রাজ পরিবারের মানুষের জন্য তৈরি ক্যাপ।এই ক্যাপগুলোই মূলত কারুকার্যখচিত ও অতি সুন্দর হত।

লিখেছেনঃঅনন্যা চক্রবর্ত্তী

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।