শিকড়ের সন্ধানে: দিল্লি সালতানাত ( পর্ব -৫)

 শিকড়ের সন্ধানে: দিল্লি সালতানাত ( পর্ব -৫)

দিল্লী সালতানাত বলতে মূলত মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনকালকে বুঝানো হয়। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে রাজত্বকারী একাধিক মুসলিম রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি “দিল্লী সালতানাত” নামে পরিচিত। এই সময় বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে।

এই রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি হল যথাক্রমে:

১.মামলুক সুলতান(১২০৬-৯০) ২.খিলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০)

৩.তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৩)

৪.সৈয়দ রাজবংশ(১৪১৩-৫১)

৫. লোদি রাজবংশ (১৪৫১-১৫২৬)

মুহাম্মদ ঘুরির প্রাক্তন তুর্কি মামলুক দাস কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লির প্রথম সুলতান ছিলেন এবং তাঁর মামলুক রাজবংশ উত্তর ভারতের বিশাল অঞ্চল জয় করেন। এর পরে, খিলজি রাজবংশ বেশিরভাগ মধ্য ভারতকেও জয় করতে সক্ষম হয়, তবে উভয়ই পুরো ভারত উপমহাদেশকে জয় করতে ব্যর্থ হয়। সালতানাতটি তুঘলক রাজবংশের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে এর ভৌগলিক সীমানার দিক থেকে শীর্ষে পৌঁছে।এর পরে বিজয়নগর সাম্রাজ্য এবং মেওয়ার মতো হিন্দু সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা দাবি করার কারণে সালতানাতের পতন ঘটে, এবং শাহী বাংলার মতো নতুন মুসলিম সালতানাতের উদ্ভব ঘটে।

দিল্লির সুলতানি আমলে , ভারতীয় সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার মিশ্রণ ঘটেছিল এবং আফ্রো-ইউরেশিয়ার বৃহৎ অংশে বিস্তৃত একটি বিশ্বব্যবস্থা এবং বিস্তৃত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কগুলির সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের যোগাযোগ আরও বেশি ছিল, যার একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সমাজের উপর। তাদের শাসনের সময়টিতে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের প্রাথমিকতম রূপগুলি, যান্ত্রিক প্রযুক্তির বৃহত্তর ব্যবহার, ভারতের জনসংখ্যা এবং অর্থনীতিতে বৃদ্ধির হারএবং হিন্দি-উর্দু ভাষার উত্থান ব্যাপক ভাবে লক্ষ্য করা যায়।দিল্লী সুলতানি ১৩ ও ১৪ শতকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক আগ্রাসন প্রতিহত জন্য পরিচিত ছিল।

১২০৬ সালে কুতুবুদ্দিন আইবেকের অধীনে দিল্লি সুলতানাতের সূচনা মধ্য এশীয় শৈলীর মতো ভারতে একটি বৃহৎ ইসলামী রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। মসজিদ এবং সমাধিসৌধের সাথে মুসলিম অভিজাতদের প্রয়োজনীয় বড় বড় বিল্ডিংগুলির ধরন এবং শৈলীগুলো পূর্ব ভারতে নির্মিত মন্দির থেকে খুব আলাদা ছিল। এগুলোতে শীর্ষে প্রায়শই বড় গম্বুজ ছিল এবং খিলানগুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা ছিল। এই দুটি বৈশিষ্ট্যই হিন্দু মন্দির স্থাপত্য এবং অন্যান্য আদিবাসী ভারতীয় শৈলীতে খুব কমই ব্যবহৃত হয়েছিল। উভয় ধরনের স্থাপত্যে মূলত একটি উচ্চ গম্বুজের নিচে একটি বৃহৎ স্থান নিয়ে গঠিত ছিল এবং হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, রূপক ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে।

দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ কুতুব কমপ্লেক্সটি ১১৯৯ সালের দিকে মুহাম্মদ ঘুরি অধীনে শুরু হয়েছিল এবং এটি কুতুবুদ্দিন আইবেক এবং পরবর্তীকালের সুলতানদের অধীনে অব্যাহত ছিল।

এটির পাশেই অত্যন্ত লম্বা কুতুব মিনার, যা মিনার বা বিজয় টাওয়ার, যার মূল চারটি স্তরে ৭৩ মিটার উচ্চতায় পৌঁছে । এর নিকটতম তুলনাকারী হ’ল ৬২ মিটারের আফগানিস্তানের জ্যাম মিনার যা দিল্লি টাওয়ারের সম্ভাব্য সূচনা হওয়ার এক দশক বা তারও বেশি আগে তৈরী হয়। উভয়ের পৃষ্ঠতল বিস্তৃতভাবে শিলালিপি এবং জ্যামিতিক নিদর্শন দিয়ে সজ্জিত করা হয়। সাধারণভাবে মিনারগুলি ভারতে ব্যবহার করা ধীর ছিল এবং প্রায়শই সেখানে উপস্থিত প্রধান মসজিদ থেকে আলাদা যেত।

কুতুবউদ্দীন আইবক দিল্লির সালতানাতের গোড়াপত্তন করেছিলেন। অতঃপর তুর্কি-আফগান সুলতানরা দিল্লিতে প্রায় তিনশ বছর রাজত্ব করেন। এ দীর্ঘ রাজত্বকালে অনেক সুলতানের রদবদল ঘটেছে; সাম্রাজ্যে নানা বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সুলতানী আমলের শেষদিকে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সালতানাতের শেষ সুলতান ছিলেন ইবরাহীম লোদী। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সুলতান ইবরাহীম লোদীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি সালতানাতের অবসান ঘটে। দিল্লি সালতানাতের পতনের পশ্চাতে নানাবিধ অভ্যন্তরীণ ত্রুটিবিচ্যুতি এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের প্রচণ্ডতা ও ধ্বংসলীলা দায়ী ছিল। স্বৈরতন্ত্রকে ভিত্তি করে দিল্লির সালতানাতের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। সাম্রাজ্যে সুলতানের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল। স্বৈরতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে শাসকের ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার ওপর। এরূপ শাসনব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। শাসক তার শক্তির নীতি প্রয়োগ করে জনগণের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন। দিল্লি সালতানাতের মাত্র কয়েকজন ব্যতীত অন্য সবাই স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনার অনুপযুক্ত ছিলেন। ফলে শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও জনগণের ওপর তাদের কর্তৃত্ব লোপ পায়।

দিল্লি সালতানাতের উল্লেখযোগ্য , শক্তিমান ও প্রতিভাশালী সুলতানরা দুর্ভাগ্যবশত কেউই উপযুক্ত উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারেননি। সুলতান শামসউদ্দীন ইলতুিমশ একজন যোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তার মৃত্যুর পর রুকুনউদ্দীন ফিরুজ, রাজিয়া, মুইযউদ্দীন বাহরাম, আলাউদ্দীন মাসুদ প্রমুখ দুর্বল উত্তরাধিকারীরা পর পর সিংহাসন লাভ করেন, কিন্তু তাদের সময়ে রাজ্যের সর্বত্র দুর্যোগ ও গোলযোগ দেখা দেয়।

দিল্লি সালতানাতের উল্লেখযোগ্য , শক্তিমান ও প্রতিভাশালী সুলতানরা দুর্ভাগ্যবশত কেউই উপযুক্ত উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারেননি। সুলতান শামসউদ্দীন ইলতুিমশ একজন যোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তার মৃত্যুর পর রুকুনউদ্দীন ফিরুজ, রাজিয়া, মুইযউদ্দীন বাহরাম, আলাউদ্দীন মাসুদ প্রমুখ দুর্বল উত্তরাধিকারীরা পর পর সিংহাসন লাভ করেন, কিন্তু তাদের সময়ে রাজ্যের সর্বত্র দুর্যোগ ও গোলযোগ দেখা দেয়।

এছাড়াও মোংগল উপজাতির ক্রমাগত আক্রমণ সাম্রাজ্যকে আরো বেশি দুর্বল করে দিয়েছিল। ফলস্বরূপ একসময় এই বিশাল সালতানাতের পতন ঘটে। এবং মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে।

লিখেছেনঃ শরিফ মেহেরিয়া

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।