শিশির ভেজা প্রকৃতি ও নবান্নের ছোঁয়ায় বাংলা কাব্য সাহিত্য

 শিশির ভেজা প্রকৃতি ও নবান্নের ছোঁয়ায় বাংলা কাব্য সাহিত্য

ঋতুবৈচিত্র‍্যের বাংলাদেশ যেন হৃদয়ে ছুঁয়ে যাওয়া মাদকতায় ভরা পুলকিত এক প্রগাঢ় নিকুঞ্জ। সে যেন এক অপরুপা রুপসী মর্তের মাটিতে স্বর্গের উর্বশী। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেমন বাংলা সাহিত্যকে রুপ-রস-গন্ধে ভরিয়ে দিয়েছে, তেমনি ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যতম। 

ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন বাংলা সাহিত্যে অনিন্দ্য সুন্দর বস্তু হিসেবে ধরা দিয়েছে। তাইতো, প্রকৃতি যখন একেক ঋতুতে একেক রুপে সাজে, কবিরা লেখার উৎসবে মেতে উঠে। রূপ-লাবণ্য ও স্নিগ্ধতায় ভরা চলমান হেমন্তকালকে নিয়ে বাংলাদেশে কবিতাচর্চার প্রথমদিক থেকেই কবিদের কবিতায় হেমন্ত ঋতুর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মধ্যযুগের অনেক কাব্য সাহিত্যে হেমন্ত স্থান পেয়েছে। মধ্যযুগের কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্ত রচিত ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের নমুনা পরিদৃষ্ট হয়। কবির ভাষায়:

       ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ

   যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’

বোঝাই যাচ্ছে, বাংলা সাহিত্যে স্নিগ্ধ-সুন্দর সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে হেমন্তের কতটুকু ভূমিকা ছিল! 

হেমন্তের স্থায়ীত্ব স্বল্প হলেও এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। ঝরা শিউলির পথ বেয়ে, সাদা মেঘের পাল উড়িয়ে, নবীন ধানের মঞ্জুরী নিয়ে শরৎ যে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের অবতারণা সৃষ্টি করে ধরণীতে হেমন্তে এসে তা পূর্ণতা পায়। শরতে আসে ফসল বোনার যৌবন, হেমন্তে ঘটে তাঁদের গৃহ-বরণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূর্ণতা নিয়ে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল লাল রায় লিখেছেন

   ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’।

কবির কল্পনাতে এই বসুন্ধরা যেন হেমন্তের বাংলা। কারণ, হেমন্তে ধনধান্যে পুষ্পে ভরে উঠে বাংলার প্রতিটি আঙিনা। মনে হয় হেমন্ত যেন নব বধূর ঘোমটা টেনে ফসলের ডালি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বাংলার প্রতি গৃহে, প্রতি আঙিনায়। বাঙালি মাত্রই মুগ্ধতায় মোহিত হয়ে উঠে ফসলের গন্ধে৷ হেমন্তের ফসলভরা মাঠে মোহিত হয়ে কবিগুরু তার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন জাতীয় সঙ্গীতে। 

 ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি/ আমি কী দেখেছি মধুর হাসি সোনার বাংলা…।’ 

হেমন্ত প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন তার ‘নক্সীকাথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের “সুখের বাসর” কবিতায়। 

 ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,

সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।

ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু

কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’

হেমন্তকালের মূল আকর্ষণ নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসব আবহমানকাল বাংলার ঐতিহ্য। ঘরে ঘরে চলে ফসল কাটার উৎসব। নতুন ধানের চালের পিঠা যেন শীতের আমেজ নিয়ে আসে।

‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান।‘

 কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘এই নবান্নে’ কবিতায় এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন হেমন্ত ঋতুর।

হেমন্তের সকালের শোভা খুবই মনভোলানো। যেন নয়ন জুড়ানো এক মধুর মূর্তি। হেমন্তে সকালে হঠাৎ চোখ আটকে যায় শুকনো জলাশয়ে ঝিমানো বেগুনি-সাদা ফুলকলিতে। কখনো মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে শিউলি ঝরে পড়ে উঠানে ৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  “নৈবেদ্য” কবিতায় উল্লেখ করেছেন হেমন্তের তেমনি এক নানন্দিকতায় ও মৌনমন্থরতায় ভরা হেমন্তের সকালের।

 ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে

    জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে

    শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার

    রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার

    স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

আবার, সারা রাতের শিশির ভেজা দুর্বাদল সকালের কাঁচা রোদে যে মিষ্টি হাসি ছড়ায় তাতে কবিগুরু বিমোহিত হয়ে বলেছেন, 

‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিষের উপরে

একটি শিশিরবিন্দু।’

রুপসী বাংলার কবি, জলাঙ্গীর কবি জীবনানন্দ দাশ হেমন্তের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দ্বিতীয় জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাংলায়। 

‘আবার আসিব ফিরে….. হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’

জীবনানন্দ দাশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কে যতটা নির্জনতায় কবিতার মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী আর কেউ পারে নি। জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় হেমন্তের দেখা মেলে। ‘হেমন্তের কবি জীবনান্দ দাশ’ প্রবন্ধে নরেশ গুপ্ত লিখেছেন, জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। 

হেমন্তের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কখনো এত সুন্দর ও ভয়ঙ্কর অনুভূত হয় যে তখন মানবমনে প্রকৃতি নারী রুপ হয়ে ধরা দেয়। আল মাহমুদের (জ.১৯৩৬) কবিতায় প্রেম প্রকৃতি সৌন্দর্য ও নারী অভিন্ন সত্তায় একাকার হয়ে মিশে আছে।

    ‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে

    আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে

    রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে

    আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর

বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো। ‘

কত কবির কত কবিতা, কত শিল্পীর কত গান এই হেমন্ত নিয়ে। আমরা প্রাণিত হই বাংলার রূপ বর্ণনার কাব্য ও গানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তের নাম দিয়েছেন শস্যলক্ষ্মী। শস্যলক্ষ্মী হেমন্ত সুখ,সমৃদ্ধি ও অমৃতের সুধা ঢেলে দিয়ে লাজুক বধুর মতো শীতের কুয়াশায় ঘোমটা টেনে বিদায় গ্রহণ করে। তাইতো, কবি সুফিয়া কামাল হেমন্তকে চিঠি লিখে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে আবির্ভূত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

    ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর

    হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে

    কোন পাথারের ওপার থেকে

আনল ডেকে হেমন্তকে?’

লিখেছেন : বৃন্তি সাহা

Brinty Saha

Related post