জুম চাষ: জীবন ও বাস্তবতা

 জুম চাষ: জীবন ও বাস্তবতা

“বাংলাদেশ ” বিষয়ক রচনা লেখার সময় প্রায়ই একটি পরিচিত বাক্য দিয়ে আমাদের প্রায় সকলেরই রচনা শুরু হতো। সেই বাক্যটি হচ্ছে, ” সুজলা,সুফলা,শস্য শ্যামলা,কৃষি প্রধান দেশ, আমাদের এই বাংলাদেশ। ” এবং বস্তুতই বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত।কিন্তু ভূ প্রাকৃতিক কারণে দেশের সব জায়গার ভূ পৃষ্ঠ এক রকম নয়।সমতল ভূমি পৃষ্ঠে কৃষিকাজ করাটা যতটা সহজসাধ্য,পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষিকাজ করা ঠিক তত টাই কষ্টদায়ক। কিন্তু জীবন ধারণের জন্য পাহাড়ি এলাকার মানুষদের উঁচু নিচু পাহাড়েই চাষ করতে হয়। এবং পাহাড়ি অঞ্চলের চাষাবাদ প্রক্রিয়াকেই বলা হয় জুম চাষ।

জুম চাষের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো। পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো ও খাসিয়া পাহাড়ের বাইরে ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা–‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত এই সাতটি রাজ্যে জুম চাষ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এছাড়া চীন, নেপাল, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠীর পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষের প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের নিজস্ব শাসনরীতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী কার্বারি (গ্রাম প্রধান) ও হেডম্যান (মৌজা প্রধান) নির্ধারণ করেন কোন পাহাড়ে কোন কোন জুমিয়া পরিবার কখন জুম চাষ করবেন। এ কারণে এ চাষাবাদ নিয়ে বিরোধ হয় না।

পাহাড়ের এই চাষ পদ্ধতি বেশ কষ্টসাধ্য। জুম চাষে একটি পরিবারের পাহাড়ি নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সকলেই অংশ নেন। আবার কোনো একটি বড় পাহাড়ে কয়েকটি গ্রামের জুমিয়ারা ঐক্যবদ্ধভাবে জুম চাষ করে থাকেন।

চাষের মৌসুমে প্রথম নির্বাচিত পাহাড়টির জঙ্গল ও আগাছা বিশেষ কৌশলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কৌশলে আগুন ধরানো হয় বলে বনাঞ্চলে এই আগুন যেমন ছড়িয়ে পড়ে না, তেমনি টিকে থাকার স্বার্থে পাহাড়ি জুম চাষ করতে গিয়ে বন ও চাষ এলাকার কোনো বড় বা দামি গাছের ক্ষতি করেন না।

বৃষ্টির পর নির্বাচিত জুমের জমিতে পুড়ে যাওয়া জঙ্গল ও আগাছার ছাই সারের কাজ করে। এর পর বিশেষ ধরনের ছোট দা এর মাধ্যমে ছোট্ট ছোট্ট গর্ত করে একই সঙ্গে কয়েক ধরণের ফসল বোনা হয়। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, কলা, তরমুজসহ জুমের জমিতে প্রায় সব ধরনের খাদ্য শস্য ও শাক-সবজি চাষ করা হয়। জুমের ফসলের বীজ সমতলের চেয়ে ভিন্ন। এসব ফসল উৎপাদনে কোনো ধরনের সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। আর জুমের শস্য, ফলমূল ও তরি-তরকারির আকার-আকৃতি সমতলের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্যের চেয়ে ভিন্ন; এগুলো খেতে খুবই সুস্বাদু।

জুমের ফসল পরিচর্যার জন্য চাষাবাদের পাহাড়ে জুমিয়ারা গড়ে তোলেন অস্থায়ী মাচাং ঘর (চাকমা ভাষায়, মোনঘর)। এই মন ঘরে চাষাবাদের মৌসুমে জুমিয়ারা একই সঙ্গে যেমন ফসলের দেখভাল করেন, তেমনি বুনো শুকর বা অন্য জীব-জন্তু ও পাখ-পাখালি যেন ফসলের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকেও তারা লক্ষ্য রাখেন। জুমের জমি ঘিরে এ জন্য ‘কাবুক’সহ নানা ধরনের ফাঁদ পাতা হয়। তঞ্চঙ্গা জুমিয়াদের আবার এসব ফাঁদ পাতার সুখ্যাতি রয়েছে।

জুমের ক্ষতিকর দিকগুলো হচ্ছে ভূমিক্ষয়; মাটির পুষ্টি উপাদান হ্রাস; ঝিরি, খাল, নদী ও লেক ভরাট এবং নাব্য হ্রাস; জীব বৈচিত্র্য হ্রাস; জমির উর্বরতা হ্রাস; এলাকার প্রতিবেশ নষ্ট করা; বন্য প্রাণির চারণভূমি হ্রাস; ভূমিধস; উষ্ণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।

সনাতন পদ্ধতির জুমচাষে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব আছে। জুমের জমি পোড়ানোর জন্য অণুজীব ও কীটপতঙ্গ ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে। যার ফলে খাদ্য-শৃঙ্খলের উপর এর বিরূপ প্রভাব এড়ানো যায় না। জমির স্বল্পতা ও চাহিদার দ্রুত বৃদ্ধি এসব কারণে পূর্বের মতো এখন আর ১০/১৫ বছরের জন্য পাহাড়কে বিশ্রাম দেয়া যায় না। এমনকি গত ২ দশক আগে পর্যন্ত জুম আর্বতন চক্রের বিরতি দেয়া হতো ৫/৭ বছর। বর্তমানে ২/৩ বছর বিরতি দিয়েই বার বার জুমচাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন পাহাড়িরা। সবচাইতে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পূর্বে যার একদমই ব্যবহার ছিল না। আগের মতো নিজেদের বীজ ব্যবহারের প্রথাও কমে আসছে। এখন জুমচাষীরা উচ্চফলনশীল (হাইব্রিড) জাতের বীজ ব্যবহারে আগ্রহী।

প্রাকৃতিকভাবেই জুমঘর শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমান সময়ে অধিকাংশ শিকার জুমের আশ-পাশে ফাঁদ পেতে ধরা হয়ে থাকে। জুমের ফসল পাকতে শুরু করলে স্বভাবগত কারণেই কিছু প্রাণি ফসলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফসল বাঁচাতে জুমচাষীদের জুম পাহারা ও রক্ষার পাশাপাশি সহজলভ্য শিকারকেও হাতছাড়া করতে চান না। আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য সীমিত শিকারকে হয়তো মেনে নেয়া যেতে পারে। পাহাড়ে বসবাসকারী জাতিসত্তার মানুষেরা স্বভাব ও ঐতিহ্যগতভাবেই কমবেশি শিকারে অভ্যস্ত। তার উপর ক্রমবর্ধমান জনবসতির দ্রুত বৃদ্ধি এবং চাহিদার যোগানের জন্য অবাধে শিকার তো হচ্ছেই এবং জুমে শিকারের একটা রেওয়াজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। অতীতেও যে ছিল না তা নয়। তখন মানুষ ছিল কম, জুমও কম করা হতো। শিকারের প্রাচুর্য ছিল বেশি। এক্ষেত্রে ভূচর পাখি (মথুরা, বন মোরগ ইত্যাদি), পাখি, মায়া হরিণ, কাঠবিড়ালি, সজারু, বাঁশ ইঁদুর/গর্তবাসী ইঁদুর (বম’রা ‘যুবই’ বলেন), ভল্লুক (মহাবিপন্ন) বেশি শিকার হয়। আর অন্যান্য প্রাণির অস্তিত্ব তো এখন নেই বললেই চলে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রভাবটা আরও বেশি। স্থল ও জলের উভয় জায়গাতেই এর ক্ষতিকর দিক আছে। বিশেষত পাখি ও ঝিরির জলজ প্রাণিকুল সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও জুমচাষীরা জুমের জন্য বড় গাছ কাটেন না এবং আগুনেও পোড়ানো হয় না তবে আগুনের জন্য ক্ষতি হতেই পারে। বাঁশ পোড়া ছাই জুমচাষের জন্য উত্তম ,তাই বাঁশ প্রধান পাহাড়ের ঢালকেই চাষীরা বেশি পছন্দ করেন। এতে বাঁশের প্রাকৃতিক বংশবৃদ্ধি ব্যহত হয়।

প্রাকৃতিক ভাবে জুম চাষ ক্ষতিকর হলেও এর পক্ষেও রয়েছে নানান যুক্তি। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের জন্য জীবিকা বা খাদ্য সরবরাহের জন্য এটাই প্রধান উপায়।

সনাতন পদ্ধতির জুম পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এটা অপ্রিয় হলেও সত্য। তাই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সেভেন সিস্টার্স, চীন, নেপাল, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস, ভূটান, শ্রীলংকা এসব দেশেও জুমচাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকাতে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। নেপাল ও বাংলাদেশের দুটো প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে SALT (Sloping Agricultural Land Technology) নামে পাহাড়ে চাষের জন্য একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু এটি জুমচাষীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এছাড়া MATH (Modren Agricultural Technology in the Hill) নামে আরও একটা পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি থাকলেও তা মাঠ পর্যায়ে পৌঁছাতেই পারেনি।

পাহাড়কে বাঁচাতে হলে পাহাড়িদেরকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুধু পরিবেশের দোহাই দিয়ে জুমচাষ বন্ধ করা ঠিক হবে না। কারণ অতীতে ময়মনসিংহের গারো ও হাজংদের জুমচাষ বন্ধ করার পর তাদের জীবনে নেমে এসেছে তীব্র সংকট। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হওয়ায় তারা দ্রুতই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে কোন রকমে টিকে আছে। কিন্তু বনভূমি উজার হওয়া থেমে থাকেনি বরং দ্রুত গতিতেই বন উজাড় হয়ে গেছে। তেমনি পার্বত্য তিন জেলায় জুম নিয়ন্ত্রণের আগে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। খুব দ্রুততার সাথেই পাহাড়ের লোক সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আর এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটাতে নতুন নতুন পাহাড় জুমের আওতায় আনা হচ্ছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাহাড়ে বিশেষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিগুলো পাহাড়িদের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং তা পালনে উৎসাহিত করা দরকার। তাহলেই হয়তো নব্য প্রস্তর যুগের শৈল্পিক চাষ পদ্ধতিটিকে আধুনিকায়ন করে টিকিয়ে রাখা যাবে। বাচিঁয়ে রাখা যাবে পাহাড় এবং জীববৈচিত্র্যকেও।

রেফারেন্স : ১. কালের কণ্ঠ ২. ব্লগ ( মুক্তমনা) ৩. উইকিপিডিয়া

লিখেছেনঃ শরিফ মেহেরিয়া

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।