ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়

 ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়

আমাদের প্রজন্মে স্বাভাবিক জীবনচরিতের একাংশে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ফেসবুক এমন এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে আপনি ঘরে বসেই জনসমাগমপূর্ণ সমাজের অনুভুতি পাবেন। শত শত ভার্চুয়াল বন্ধুদের কেউ না কেউ প্রত্যেক মুহূর্তে নিজের অফলাইন জীবনের বিশেষ ঘটনাগুলো লেখা, ছবি বা ভিডিও দিয়েই তুলে ধরছেন, সঙ্গে আপনিও। রিয়েক্ট, কমেন্ট, শেয়ারের মাধ্যমে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। আবার মেসেঞ্জারে কথা বলার মাধ্যমে যোগাযোগও রাখতে পারছেন। বেশ একটা প্রানবন্ত ব্যাপার, তাইনা?!

কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই আমরা আমাদের সামাজিকতা হারিয়ে ফেলছি না তো?!

চলুন দেখে নেওয়া যাক, ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে

ফেসবুকে আপনি কাউকে সামনাসামনি না দেখতে পেলেও স্ক্রিনের পেছনে মানুষটা কিন্তু উপস্থিত বিদ্যমান। আমরা অনেকেই সেটা ভুলে যাচ্ছি। তাই যে কথাটা হয়তো আপনি সামনাসামনি দেখা হলে বলতেন না, সেটা তাকে বলে ফেলছেন। এমন একটা ব্যাপার যেটা আসলে আপনার মনে হচ্ছে, কিন্তু মুখের উপর কাউকে বলে দেওয়াটা আস্পর্ধার ব্যাপার।

কিংবা ক্রোধান্বিত হয়ে কিছু বলেছেন, যেটা অফলাইনে হলে আপনি দমিয়ে রাখতেন। আবার এমনও হতে পারে যে আপনি তর্কাতর্কি করে অভ্যস্ত না কিন্তু শুধুমাত্র সামনাসামনি মানুষটিকে দেখতে পারছেন না বলে যেটা মনে হচ্ছে সেটা অনর্গল বলে যাচ্ছেন। এমনকি যে ভাষায় বলছেন সেটাও শ্রুতিকটু।

★কমেন্ট করার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়:

যেকোনো পোস্টে শ্রুতিকটু শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন। কারণ আপনার কমেন্টটি অনেকের চোখে পড়বেন। সেক্ষেত্রে চেনা পরিচিতরা আপনার সম্বন্ধে খারাপ ধারণা করতে পারেন এবং পোস্টদাতা খানিকটা লজ্জা ও ইতস্ততবোধ করতে পারেন।

কেউ বিতর্কমূলক কোনো বিষয়ে নিজের ধারণা পোস্ট করার পর আপনার সাথে মতভেদ থাকলে সেখানে কমেন্ট না করাই শ্রেয়। টানা আপনার মতবিরুদ্ধ কিছু দেখার পর আপনার সেটাকে ভুল কিংবা বিকৃত ধারণা বলে মনে হলে আপনার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে তাকে মুছে ফেলুন। হরহামেশা দেখা হয় এমন মানুষকে সচরাচর সেটা করা যায়না। সেক্ষেত্রে তাকে আনফলো করতে পারেন।  

তারপরেও যদি কমেন্ট করতে চান, সেক্ষেত্রে তার মতবাদের সাথে সংযোগ রেখে না বলে সুন্দর ভাষায় পৃথকভাবে নিজের মতামত উপস্থাপন করার চেষ্টা করুন।

যদি আপনার পোস্টের মূলমন্ত্রের সাথে মতানৈক্য হচ্ছে এমন কারো কমেন্ট পেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে তার সাথে তর্কাতর্কি না করে এমন কিছু লিখে রিপ্লাই দিন যেখানে সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা থাকবেনা। সেটা হতে পারে এমন কোনো বাক্য, ‘আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ’।

যদি এরকম কিছু লিখতে আপনার অহঙে বাঁধে তাহলে আপনি সেই কমেন্টটির রিপ্লাই নাও দিতে পারেন।

অবশ্যই কমেন্টবক্সে তর্কের সৃষ্টি করবেন না। তর্কের মাধ্যমে মানুষ সবসময় বিপরীত মানুষটির ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নিজের ধ্যানধারণাকে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে আপ্রাণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তর্কের সময় কেউ কারো থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করার মানসিকতা রাখেনা। তাই তর্ক কখনোই কোনো বিষয়ে সমাধান আনতে পারেনা।

★পোস্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়:

এমন কোনো পোস্ট দিবেন না যা কোনো ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণি, ভাষাগোষ্ঠীকে ছোট করে। প্রত্যেকে নিজের ধর্ম এবং ভাষা ব্যবহারের অধিকার রাখে। তাই ধর্ম বা ভাষা কখনোই কারো মান নির্ধারণ করতে পারেনা। প্রতিটি মানুষ প্রাকৃতিকভাবে একধরণের গাত্ররং নিয়ে জন্মায় বা উচ্চতার হয়ে থাকে। এখানে ব্যক্তির নিজস্ব হাত নেই৷ তাই এসব নিয়ে মজা করা হয় এমন কোনো পোস্ট দিয়ে থাকলে তা সেইসব মানুষদের হীনমন্যতার জন্য দায়ী হবেন আপনি।

  • আপনি হরহামেশাই নতুন পোশাক কিনছেন, নতুন নতুন জায়গায় যাচ্ছেন, নতুন খাবারের স্বাদ আস্বাদন করছেন। আপনার আইডিতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের কাছে এটা অপূরণীয় স্বপ্ন। তারা নিজেদের নিউজ ফিড ঘুরে দেখতে দেখতে বিষাক্ত বোধ করতে পারেন বা আফসোস করতে পারেন কিংবা ঈর্ষান্বিত বোধ করতে পারেন।

তাই বলে কি কখনোই পোস্ট দিবেন না? না, অবশ্যই দিবেন। তবে সময় পরিস্থিতি বুঝে। যেমন: আপনি ঈদে আপনার ঘোরার ছবিগুলো আপলোড করতেই পারেন। কিন্তু কয়টি জামা কিনলেন, কোথা থেকে কত দিয়ে কিনলেন বা কেনার সময় কত দাম দিয়ে কত মজার মজার খাবার কিনলেন তার ক থেকে চন্দ্রবিন্দু সবকিছু ডে দেওয়া বা পোস্ট না করলেও আপনার আনন্দের কমতি হবেনা।

কিন্তু আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে এমন অনেকেই থাকবেন যাদের বাবার নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই বা ঘরে বসে বিষণ্ণ ঈদ কাটাতে হচ্ছে। আবার আমরা এখন করোনার প্রাদুর্ভাবে ঘরে বসে আছি প্রায় ছয় মাস। এসময়ে অনেকের বাবারই চাকরি চলে গেছে বলে তিনবেলা খাবার যোগান দিতেই সমস্যা হচ্ছে। কারো কাছে ধার চাইতেও আত্মসম্মানে লাগতে পারে।

তিনি যদি হঠাৎ এসে দেখেন ফেসবুক ভর্তি সবাই ঘরে বসে কত রকম খাবারের ছবি, তার একটু হলেও খারাপ লাগবে। এটা ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ব্যাপার। তাই পোস্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে দয়া করে একটু পরিস্থিতি বিবেচনা করবেন।

★ফেসবুকই হয়ে উঠতে পারে আপনার সিভি

আজকাল ফেসবুক ব্যবহার করেন না এমন তরুণ তরুণীর সংখ্যা কম। তাই যেকোনো জব সেক্টর, প্রফিট ও নন প্রফিট অর্গানাইজেশনের কাজের ব্যাপারে মানুষকে জানাতে ও নতুন লোক নিয়োগের জন্য ফেসবুকে পেইজ ও ইভেন্ট খুলে রিচ করানো হয়। এতে করে যেসব মানুষরা কাজের ব্যাপারে ফেসবুকে সার্চ দেন বা সংশ্লিষ্ট পোস্ট দেখেন এবং রিয়েক্ট শেয়ার দিয়ে পাশে থাকেন তাদের নিউজ ফিডে পোস্ট আসে।

এর মাধ্যমে অনেকেই আজকাল নিজের পছন্দের চাকরি বাছাই করতে পারছেন। আবার সংস্থাগুলো থেকেও আবেদন করার সময় ফর্মে ফেসবুক আইডি চাওয়া হয় কেননা একজনের ফেসবুক আইডি তার জীবনচরিত তুলে ধরে। তাই আপনি আজই আপনার ফেসবুকটিকে ফর্মাল সিভি বা বায়োডাটার মতো করে বানাতে পারেন।

  • ফেসবুকে আপনার সার্টিফিকেটের নাম ইংলিশে দিন।
  • প্রোফাইল পিকচারে নিজের ছবি প্রদান করুন। এমন কোনো ছবি যেখানে আপনার চেহারা স্পষ্ট বোঝা যায়। এক কালার কিংবা ব্লার ব্যাকগ্রাউন্ডে ১:১ রেশিওর রঙিন বা সাদাকালো ছবি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
  • বায়োতে তিন শব্দের নিজেকে প্রকাশ করুন। সঙ্গে নিজের জাতীয়তাবাদ লিখতে পারেন বা নিজের দেশের পতাকার চিহ্ন দিতে পারেন। রক্তের গ্রুপের জায়গায় নিজের সঠিক রক্তের গ্রুপ লিখুন৷ সঙ্গে বায়োতেও।
  • নিজের একটি ব্যক্তিগত আরেকটি কার্যসূত্রে ইমেইল এড্রেস তৈরি করুন। কাজের জন্য ব্যবহৃত মেইল এড্রেসটি পাব্লিক প্রাইভেসি দিয়ে যোগ করুন। সঙ্গে নিজের ইন্সটাগ্রাম, টুইটার আর লিংকড ইন আইডি যোগ করুন। এতে সবাই সেই যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও আপনার বিচরণ সম্বন্ধে জানতে পারবে এবং আপনার রিচ হবে।
  • ইন্ট্রোতে জীবনে যতগুলো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন সেগুলো যথাক্রমে সময়সীমাসহ যোগ করুন।
  • যেসব জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা আছে সেসব জায়গার সেবার বৃত্তান্ত ও সেখানে নিজের পোস্ট এবং অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত যোগ করুন।
  • যেসব দক্ষতা আছে সেগুলো যোগ করুন। পারলে প্রতিটি দক্ষতা প্রকাশের জন্য আলাদা আলাদা এলবাম খুলে সেগুলোর ছবি/ভিডিও পোস্ট করতে পারেন। এতে নিয়োগদাতা আপনার আইডি ঘুরে তার প্রমাণ পাবেন।
  • নিজের অর্জনের অভিজ্ঞতা লিখে তার সাথে প্রাপ্ত সম্মানী, মেমেন্টো, সনদ বা মেডেলের ছবি দিয়ে তার জন্য আলাদা একটি ফটো এলবাম করুন। এতে আপনার চাকরির সম্ভাবনা একধাপ বাড়তে পারে।

সর্বোপরি ফেসবুকে সব সঠিক তথ্য প্রদান করুন। সুরুচিপূর্ণ ও শিক্ষামূলক কন্টেন্ট বহনকারী আইডি, পেইজ ও গ্রুপের সাথে থাকুন। নিজেও সঠিক সামাজিকতা বজায় রাখুন।

লেখক:উম্মুল খয়ির ফাতেমা

RedLive

Related post