একজন জুবায়ের হোসাইনের সফলতার গল্প

 একজন জুবায়ের হোসাইনের সফলতার গল্প

আজকে একজন অসাধারণ মানুষের গল্প বলবো যার জীবন ঠিক স্বপ্নের মত আবার স্বপ্নভঙ্গ এবং স্বপ্ন জয়ের গল্প।তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে পার্টনারশিপে স্টার্ট আপ খোলেন।কিন্তু সফলতার বদলে পেলেন পার্টনার থেকে ধোঁকা।তিনি এত কম বয়সে উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থতার শিকার হলেন কিন্তু এই ব্যর্থতা তাকে একটুও দমাতে পারেনি বরং আগের চেয়ে আরো বেশি মজবুত এবং সাহসী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন।তিনি প্রমাণ করেছেন ব্যর্থ হওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়, বরং জীবনের নতুন শুরু।

তাই তো তিনি Vat Checker, Top Tube এর মতো দারুন সফটওয়্যার তৈরি করেন যা বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।বলাবাহুল্য, Vat Checker এক বছরেই বাংলাদেশ সরকারের সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।Top Tube এর ও ব্যবহারকারী ৬-৭ মাসের মধ্যেই এক মিলিয়ন অতিক্রম করে।এ থেকে তিনি প্রচুর অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করলেও  দূর্ভাগ্যবশত তার এই সফলতা মুহূর্তে চুরমার হয়ে যায়।

Vat Checker এ কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় মানুষ সমানে রিপোর্ট করতে থাকে এবং ডাটা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গুগল তার সম্পূর্ণ একাউন্ট বন্ধ করে দেয়।ফলে  একাউন্টের ভেতর রাখা সকল স্টার্টআপ ও ওখানেই শেষ হয়ে যায়।এতো কিছুর পরেও তিনি স্বপ্ন দেখা ছাড়েন নি এবং আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছেন।

তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি আ্যপ Bongo Scanner কে বিশ্ব দরবারে প্রেজেন্ট করলেন এবং অবাক করা বিষয় মাত্র দুদিনেই আ্যপটি টপ ট্রেন্ডিং এ চলে এসেছে। তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে দেশ এবং দেশের বাইরে নিজেকে এক আইডল এবং অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে সেট করতে সক্ষম হয়েছেন।তিনি আর কেউ নন। তরুণ উদ্যোক্তা এবং সফটওয়্যার নির্মাতা “জুবায়ের হোসাইন”।

আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া। Red Live থেকে খাতুন ই জান্নাত বলছি। কেমন আছেন?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।ভাইয়া আজকের সাক্ষাৎকারে আপনাকে পেয়ে আমরা আনন্দিত।আশা করছি অনেক কিছু জানতে পারবো আপনার জীবনের সফলতা সম্পর্কে এবং অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে।

আমরা সবাই আপনাকে Vat checker, Top tube, Bongo scannerএর founder হিসেবে জানি।এর মধ্যে আপনার প্রথম দুটি উদ্যোগ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল এবং বর্তমানে Bongo scanner  টপ ট্রেন্ডিং এ আছে।এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?

-অনুভূতি টা অবশ্যই ভালো।দীর্ঘদিন কাজ করার পর যখন সেটা মানুষ ভালো বলে, বিশেষ করে মানুষের উপকার হয় এবং খুব ভালো ফিডব্যাক আসে তখন আসলেই খুব ভালো লাগে।

Vat scanner, Top tube এর মতো ভিন্নধর্মী আ্যপ বানানোর পর আপনার Bongo scanner আ্যপ বানানোর কথা কেন মনে হলো? এর কারন কি? কাদের উদ্দেশ্যে এই আ্যপটি তৈরি করেছেন?

-এটা তৈরির কারন হচ্ছে, আমি ফ্রিল্যান্সিং এর বিভিন্ন সাইট নিয়ে যখন গবেষণা করছিলাম,তখন দেখছিলাম যে এমন অনেক জব আছে যেখানে একটা পিডিএফ ফাইল বা কিছু ছবি থেকে লেখা আলাদা করার জন্য মানুষকে আলাদা পে করা লাগে এবং এটি বেশ সময়সাপেক্ষ।

এখন ২০২০ এ মানুষের এসব কাজ হাতে লিখে করার মতো সময় নেই।তখন মনে হলো আমি এমন একটা কাজ করতে পারি যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে মানুষ কাজগুলো নিমিষেই করতে পারবে।

মানুষকে অন্য কোথাও যেতে হবে না। তাছাড়া আমরা বিভিন্ন সময় দলিল বা ফাইলগুলোকে কম্পিউটার দোকানে নিয়ে যাই, সেখানে লোকগুলো দেখে টাইপ করে এডিট করে নতুন একটা ফাইল তৈরি করে দেয়।এতে তার অনেক সময় লেগে যায়।

Bongo Scanner এর কারনে তাদের কাজটা এখন আরো সহজ হয়ে যাবে এবং অনেক সময় বেঁচে যাবে।এই চিন্তা ভাবনা থেকেই এটা বানানো।আর এটা সবার উদ্দেশ্যে বানানো।সবাই যেন উপকৃত হতে পারে সেই চিন্তা করেই তৈরি করা হয়েছে।

আপনি একটি উদ্যোক্তা সম্মেলনে বলেছিলেন, “যে কোন উদ্যোগ গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই মনে রাখতে হবে উদ্যোগ থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কতোটা উপকার হচ্ছে।” আপনার রাজস্ব বাঁচানোর স্বপ্ন নিয়ে তৈরিকৃত Vat checker তারই প্রমাণ দেয়।এক বছরে সাড়ে তিনশো কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে Vat checker

এই ক্ষেত্রে Bongo scanner আমাদের দেশের জন্য কীভাবে ও কতোটা সুফল আনবে বলে আশা করছেন?

-জি অবশ্যই। আমি এই কথাটা এভাবে বলেছিলাম, ঠিক দেশ না, দেশের সকল মানুষ এমনকি দেশের বাইরের মানুষের কল্যানে আসবে এমন উদ্যোগ অবশ্যই সফলতার মুখ দেখবে।সে সার্ভিসটা হোক ইলেকট্রিক্যাল বা আ্যনালাইটিকাল মানুষের জীবন যাত্রা উন্নত করেছে বা সহজ করেছে সেটাই সফলতা।কোন উদ্যোগ যদি মানুষের জীবনে সামান্যতম ভ্যালু যোগ করে সেই কাজটাই সফলতার দিকে যাবে।কাজেই Bongo Scanner ঐ চিন্তা থেকেই করা।

আমি যদি শুধু স্টুডেন্টদের কথাই বলি এমন হাজার হাজার স্টুডেন্ট আছে যাদের এসাইনমেন্ট করতে হয়।যারা বিভিন্ন বই থেকে,নেট থেকে বা অন্য উৎস থেকে লিখা গুলো সংগ্রহ করে টাইপ করতে হয়।যেটাতে অনেকটা সময় চলে যায়।তখন Bongo Scanner থাকলে তার কাজটা সম্পূর্ণ সহজ হয়ে যাবে।শুধু একটা ছবি তুলবে এবং লিখাটা কপি হয়ে যাবে।

যদি ব্যাংক বা অন্যান্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কথা বলি সেখানে অনেক ডকুমেন্টেশনের কাজ করতে হয়।তখন Bongo Scanner হবে সবচেয়ে উপকারী একটি মাধ্যম।আমি পূর্বেই বলেছি কম্পিউটার দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করা লাগে একটা ফাইল বা দলিল টাইপ করার জন্য।এটা আর প্রয়োজন হবে না।

অনেক সময় বেঁচে যাবে।মূলত Bongo Scanner মানুষের সময়,শ্রম বেঁচে যাবে এবং কাজগুলো হবে নিখুঁত ও দ্রুত।তাই, আশা করছি পুরোনো কাজের মতোই Bongo Scanner মানুষের ভালোবাসা কুড়াবে।

আপনার পূর্বে তৈরিকৃত বেশ সুনাম অর্জন করা আরেকটি আ্যপ  Top tube, যেটা পরে ডাটা পলিসি সংক্রান্ত জটিলতায় গুগল একাউন্টটি মুছে দিয়েছিল। এমনকি Vat checker এর ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।আপনি আপনার এক ভিডিও তে বলেছিলেন যে আপনি সে সময় বেশ ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলেন।

এই মুহূর্তগুলোতে পরে নিজেকে কীভাবে সামলে নিয়েছেন?

-সাধারণত আমি সবসময়ই একটা জিনিস বিশ্বাস করি, “What we can do is we can try.” ফলাফল একমাত্র আল্লাহর হাতে।আমাদের সফলতা কবে, কীভাবে আসবে এটা আমরা নির্ধারণ করতে পারি না।আমরা সারাদিন পরিশ্রম করতে পারি কিন্তু তাতে সফলতা আসবে কিনা তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না।

আমার যখন এমন হলো বিশেষ করে Vat Checker এর ক্ষেত্রে ,তখন চিন্তা করলাম যে এই ব্যাপারগুলোর উপর তো আমার নিয়ন্ত্রণ নেই।আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি। কাজেই আমি যেটা করতে পারি সেটা হলো আমি আবার নতুন করে শুরু করবো। এখন আমি যদি এককোনায় হতাশ হয়ে পড়ে থাকি তাহলে কিছু করতে পারবো না। তাই আমি নিজেকে অনুপ্রানিত করি এবং অগ্রসর হই।

আপনার কো ফাউন্ডারের সাথেও আপনার সমস্যা তৈরি হয় যার কারনে আলাদা হতে হয়েছিল, তখন সবকিছু কীভাবে সমাধান করেছেন?

-আসলে আমারো কিছু ভুল ছিল।তখন আমি ছোট।ছোট বলতে মাত্র ১৫ বছর বয়সে কোম্পানি শুরু করি।এই বয়সে অনেক কিছু বুঝতাম না।প্রাইভেসি কি কতোটা জরুরি এগুলো বুঝতাম না এবং পার্টনার কে অতিরিক্ত বিশ্বাস করতাম।সেই না বুঝা এবং অতিরিক্ত বিশ্বাস থেকে সে বেঈমানি করার সুযোগ পায়। আমার সফটওয়্যার গুলো কপি করে এবং অন্যান্য সমস্যা করে।

তারপর থেকে শিক্ষা নিলাম। প্রাইভেসি মেইনটেইন করা, টার্মস গুলো ঠিক রেখে কাজ করা এগুলো শিখলাম। এটা একটা লার্ণিং হিসেবেই নিয়েছি এবং যথেষ্ট সতর্ক হয়েছিলাম তাই আর এই ধরনের সমস্যায় ও পড়তে হয় নি।

হার না মেনে লড়াই করে যাওয়া নিয়ে নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ গুলো কি কি?

– তাদের জন্য দুইটা পরামর্শ

১। উদ্যোক্তা হতে গেলে You will have to fail, ব্যর্থ হতেই হবে।না হলে সফল হবেন না।আপনি আমাকে এমন কোন সফল ব্যক্তির উদাহরণ দিতে পারবেন না যারা ব্যর্থ হয়নি।প্রথম চেষ্টায় সফল হয়েছে এমন কেউই নেই।ঐ জায়গা থেকে বলবো টিকে থাকা একটা বিষয়।

২।এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দুটা জিনিস গুলিয়ে ফেলি। Survival and goal. ধরুন আপনি একটা বড় কোম্পানি তৈরি করতে চান সেটার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের পন্যের লেনদেন করবেন।এটা হচ্ছে আপনার goal অথবা লক্ষ্য। এমন ও হতে পারে যে আপনার পকেটে খাওয়ার জন্য টাকা নেই। তখন আপনার হয়তো হোটেল বয় হিসেবে কাজ করা লাগছে।

এই কাজ করাটা হলো survival।Survival এবং goal এর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে হবে।এই দুইটাকে একত্র করা যাবেনা।অনেক সময় দেখা যায় অনেকেই পরিবারের সাপোর্টের অভাবে ,আর্থিক সমস্যা বা অন্য যে কোন পারিপার্শ্বিক সমস্যার কারনে survival কে goal বানিয়ে নেয়। এটা করা যাবে না।

আমি যদি আমার goal এর কথা বলি, আমার goal  হলো মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন  করা। আমি আবার দেশি বিদেশি ক্লায়েন্ট এর জন্য কাজ করছি। সেটা আমার survival, উদ্যোক্তাদের এই জিনিসটা সবসময়ই মাথায় রাখতে হবে।

আপনার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঠিক কি কি কারনে ডেভেলপার একাউন্ট মুছে দিতে পারে এবং এই ক্ষেত্রে করণীয় কি?

– ডেভেলপার অনেক গুলো কারনে একাউন্ট মুছে দিতে পারে। তার মধ্যে বেসিক কিছু কারন:

যখন একটা account এ multiple apps বা multiple start up আপলোড করা হয়,যদি কোন কারনে একটা আ্যপ ভায়োলেশন এর স্বীকার হয় তখন গুগল এ একাউন্টের সকল আ্যপস মুছে দেয়। পুরো একাউন্টাই মুছে দেয়। সেক্ষেত্রে individual start up কে individual account এ রাখা উচিত।তাহলে অন্তত একটা একাউন্ট নষ্ট হলে অন্যগুলো হারিয়ে যাবে না।

আরেকটা কারন হতে পারে প্রাইভেসি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে। ধরুন আপনি দেখাচ্ছেন ১৮+ আ্যড কিন্তু ব্যবহারকারীর বয়সসীমা দিয়ে রেখেছেন ১৫+, তখন একটা conflict তৈরি হয়। এসব কারনেও সমস্যা দেখা দেয়।

এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করছেন, কি কি বাটা পলিসি আছে এগুলো মাথায় রেখে কাজ করা উচিত।

যদি কেউ চায় আ্যপ তৈরি করবে তাহলে কি যে কেউ পারবে?

– আমি মনে করি যে কেউই চেষ্টা করলে পারবে। কিন্তু তার ইংরেজি এবং টাইপিং দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। যেন সে যে কোন টিউটোরিয়াল দেখে সহজে বুঝতে পারে।

আপনি ভবিষ্যতে নতুন কি কি করার পরিকল্পনা করছেন?

– ধারাবাহিক ভাবে আরো কিছু ইন্টারন্যাশনাল মানের উদ্যোগ তৈরি করা।

বিশ্ব বাজারে যেন বাংলাদেশী প্রোডাক্ট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে সেটা আমার স্বপ্ন।সেটা নিয়ে কাজ করছি।

বাংলাদেশী তরুণদের নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি তাদের নিয়েও পরিকল্পনা আছে।আসলে আমি একা না,সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইল।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: খাতুন ই জান্নাত বিবি ফাতেমা

RedLive

Related post