করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশী উদ্যোগঃ পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ

 করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশী উদ্যোগঃ পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ

করোনা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশী তরুণেরা বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। তাদের হাত ধরে যেমন তৈরি হয়েছে জীবিকা অর্জনের সুযোগ, তেমনি সহায়তা হচ্ছে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলোরও।করোনাকালে বাংলাদেশী তরুণদের গড়া তেমনি একটি উদ্যোগের নাম ‘পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ’। যার কারিগর দুই বন্ধু তাহমিদ হাসান ও রফিউল এম চৌধুরী ২৩শে মার্চ, ২০২০ তারিখে যাত্রা শুরু তাদের। চলুন জেনে নেই করোনাকালে এই বাংলাদেশী তরুণদের গড়া এই উদ্যোগটি সম্পর্কে।

প্রজেক্ট গ্রন্থমঙ্গল

ঢাকার নীলক্ষেত বইপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্যের মতো। নতুন বা পুরোনো, দেশি হোক বা বিদেশি, বাংলা ভাষার বা অন্য ভাষার সব ধরণের বই পাওয়া যায় এখানে। কিন্তু করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পরই নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানীরা পড়ে গেলেন বিপদে। মহামারীর কারণে বইয়ের বিক্রি গেলো কমে। বই বেঁচে সংসার চালানো দূরে থাকুক, দোকানভাড়া দিতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন অধিকাংশ দোকানী।

এ অবস্থায় অনেককেই ছাড়তে হলো দোকান। কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নিলেন। কেউ বা রাস্তার ধারে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্রি করতে শুরু করলেন বই। নীলক্ষেতের বই বিক্রেতাদের এরূপ অবস্থা দেখে কষ্ট পেলেন দুই বন্ধু। ভাবতে শুরু করলেন কিভাবে নীলক্ষেতের বই বিক্রেতাদের পাশে দাঁড়ানো যায়। এ চিন্তা থেকেই তারা হাতে নিলেন একটি উদ্যোগ- প্রজেক্ট গ্রন্থমঙ্গল!

মে মাস থেকে চালু হয় এ উদ্যোগের কার্যক্রম। এ প্রজেক্টের অধীনে তারা নীলক্ষেতের বই বিক্রেতাদের সহায়তা করার জন্য তাদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলোর প্রতিটি ২০০ টাকায় বিক্রি করতে শুরু করেন। বই বিক্রয়লব্ধ পুরো টাকা ব্যয় হয় দুস্থদের সাহায্যে। পাশাপাশি বই কিনে সহায়তা করা হয় নীলক্ষেতের বিক্রেতাদেরও। এতে গৃহবন্দী সময়ে পাঠকেরাও বইয়ের খোরাক মিটিয়ে নিতে পারেন।

বই অর্ডার করতে ‘পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ‘ এর ফেসবুক পেইজে ইনবক্স করতে হয়। ঢাকার ভেতরে কোনো ডেলিভারি চার্জ লাগে না, তবে ঢাকার বাইরের জন্য নেওয়া হয় ১৫০ টাকা। এ কাজটি ছাড়াও স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বিপদে পড়া নীলক্ষেতের স্টেশনারী দোকানীদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে তারা খাতা-কলম-রঙ পেন্সিল কিনে নিয়েছেন, পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে। বইয়ের সংখ্যা যত বেশি, সহায়তার পরিমাণটাও হয় তত বড়। তাই তারা পাঠকদের একাধিক বই অর্ডার দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।

প্রজেক্ট গ্রন্থমঙ্গলের আওতায় এখন পর্যন্ত ১৩,৬০০টিরও বেশি বই বিক্রি হয়েছে। বই পেয়েছেন ২০২০ জনের অধিক লোক আর এর মাধ্যমে সাহায্য হয়েছে ১০০ জন বই-বিক্রেতার।

প্রজেক্ট সুরক্ষা

এদেশে করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর এই দুজন বন্ধু ভাবতে শুরু করলেন যে এই করোনাকালীন কঠিন সময়ে কিভাবে সুবিধাবঞ্চিত ও হতদরিদ্র শিশুদের পাশে থাকা যায়। সে ভাবনা থেকেই তারা হাতে নিলেন আরো একটি উদ্যোগ, যার নাম ‘প্রজেক্ট সুরক্ষা’

মূলত ঢাকা শহরের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে তারা কাজ করেন। ‘প্রজেক্ট সুরক্ষা’ এর মাধ্যমে করোনাকালে সুলভমূল্যে সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রয় করার চিন্তা শুরু করলেন। এতে ডেলিভারি চার্জ  ঢাকার ভেতরে ১০০ টাকা, ঢাকার বাইরে ১৪০ টাকা। কিন্তু সবচেয়ে ভালো বিষয়টি হলো আপনি যদি একটি মাস্ক ক্রয় করেন, তাহলে এর ৫০ টাকা ব্যয় হবে করোনায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ‘বেবি ফুড’ বা শিশুখাদ্যের জন্য!

প্রতিটি ভাল মানের গুঁড়োদুধের প্যাকেটের দাম ৩৫০ টাকা। তার মানে দাঁড়ায়, প্রতি সাত জন ক্রেতায় এক প্যাকেট গুঁড়ো দুধ পাচ্ছে একটি সুবিধাবঞ্চিত শিশু। এছাড়াও তারা সাশ্রয়ী মূল্যে অক্সিমিটার বিক্রয় করছে এবং এতেও একই উদ্দেশ্যে একই পরিবহন খরচ নেওয়া হচ্ছে।

প্রজেক্ট সুরক্ষার মূল লক্ষ্য হলো প্রয়োজনীয় নিরাপদ স্বাস্থ্য সরঞ্জামগুলো জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়া। এছাড়া, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিতকরণও তাদের লক্ষ্য। এই প্রজেক্টের অধীনে তারা এখন পর্যন্ত ১৮৬০ বক্স এরও বেশী সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ২১০টিরও বেশি অক্সিমিটার বিক্রয় করেছে। যার মাধ্যমে এই দুঃসময়ে ২৫০টি দরিদ্র শিশুর জন্য শিশুখাদ্যের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে।

উপরোল্লিখিত কার্যক্রম ছাড়াও ‘পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ’ দরিদ্র কৃষক, তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠী, ভাসমান বেদে ও মান্তা সম্প্রদায়, গারো সম্প্রদায়,তাঁতপল্লী, ভাসমান যৌনকর্মী ও ঢাকার বিভিন্ন বস্তিবাসীদেরও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। 

এভাবে এই কঠিন সময়েও দেশের জনগণের জন্য কাজ করে চলেছে বাংলাদেশী তরুণদের গড়া উদ্যোগ- ‘পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ‘। লাখো তরুণকে নতুন উদ্যোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করছে, স্বপ্ন দেখাচ্ছে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের সেবা করার।

লেখকঃ শাহনেওয়াজ আহমদ

RedLive

Related post