ফারাহ্ দিবা’র দেশী কাপড় নিয়ে “নিথান” এর স্বপ্ন যাত্রা

 ফারাহ্ দিবা’র দেশী কাপড় নিয়ে “নিথান” এর স্বপ্ন যাত্রা

প্রতিবেদকঃ রিয়ানুর ইসলাম

এই তো কয়েক দশক আগে কর্মক্ষেত্রে নারীদের পদচারণা চোখে পড়ার মতো ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে নারীরা কোনো কাজেই পিছিয়ে নেই। তারা তাদের নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এই আধুনিক যোগ আর স্মার্ট ফোন এর মাধ্যমে। এখন নারীরা ঘরে বাইরে সব পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। এবং সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। আজকে কথা বলবো নারী উদ্যোক্তা ফারাহ্ দিবা’র সাথে।

প্রতিবেদকঃ প্রথমে আপনার পরিচয় ছোট করে? আপনার শৈশব থেকে শুরু করবেন।

ফারাহ্: আমি ফারাহ্ দিবা, যশোর শহরে আমার জন্ম। এই শহরেই আমার শৈশব, কৈশোর, বেড়ে ওঠা। এটাই আমার পিতৃভূমি। মা যশোর শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক হবার সুবাদে শিক্ষা জীবন শুরু হয় সেখান থেকেই। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পূর্ণ করে যশোরের শিক্ষা জীবন গুটিয়ে চলে আসি ঢাকায়। গ্র্যাজুয়েশন এখানেই কমপ্লিট করি। আমার শিক্ষা জীবনে বলার মতো কোনো এচিভমেন্ট নেই। খুবই সাদামাটা, বর্ণহীন।
বিবাহ এবং কর্ম সূত্রে আমি এখন ঢাকা নিবাসী। কিন্তু কর্মের শিকড় যশোরেই প্রোথিত আছে। যশোরের প্রান্তিক নারীর হাতেই প্রস্তুত হয় আমার “নিথান” এর পণ্য।

প্রতিবেদকঃ কিভাবে আপনার উদ্যাগ টি শুরু করেছেন?
ফারাহ্: শিক্ষাজীবন বর্ণ বিহীন ছিল বলেই হয়তো আমার কর্মজীবন অত্যন্ত বর্ণিিল। টিচিং দিয়ে কর্মজীবন শুরু। কিন্তু একমাসেই বুঝতে পারলাম ওটা আমাকে দিয়ে হবে না। ছেড়ে দিয়ে জব খুঁজতে শুরু করলাম। মাত্র ২৫০০ টাকা সম্মানিতে রিপোর্টার হিসেবে চাকরী শুরু করি একটা মিউজিক ম্যাগাজিনে।
আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল সেটা। চার বছরের চাকরীতে আমি অনেক কিছু অর্জন করি। সব থেকে বেশি অর্জন করেছিলাম বাস্তব জ্ঞান। জীবিকার তাগিদে চাকরীর পাশাপাশি আমি আমার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করি। তখন উদ্যোক্তা শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলাম না। শুধু একটাই উদ্দেশ্য ছিল ‘অর্থ উপার্জন’। টাকা ধার করে যশোর থেকে হাতের কাজের পণ্য এনে ঢাকায় সেল করতাম। সাদা অর্থে যাকে বলে ‘রিসেলিং’। বেশিদিন চালাতে পারিনি। একটা দুর্ঘটনায় পুঁজি হারাতে হয় আমাকে। এর পরপরই আমি ফিচার রাইটার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। একবছর পর উদ্বোধন করি আমার প্রথম বিজনেস প্রতিষ্ঠান “স্কেচ কমিউনিকেশন্স”।

দীর্ঘ ১০ বছর সময় দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান কে দাঁড় করিয়েছি। এটা আমার এবং আমার হাজবেন্ডের যৌথ উদ্যোগ। একটা সময় অনুভব করলাম, আমার একান্ত নিজের একটা পরিচয় প্রয়োজন। এই অনুভব থেকেই ভাবতে শুরু করলাম কি করা যায়, কি করা উচিত। সব ভাবনার সুঁই এসে আটকে যায় যশোরের হাতের কাজের পণ্যে। আগে না বুঝলেও তখন বুঝতে পারি যে আমার উদ্যোক্তা হবার বীজ সেই ‘রিসেলিং’ এই বোনা হয়েছিল। দীর্ঘ ৫ মাসের প্রস্তুতিতে জন্ম নেয় আমার “নিথান”। আমার মা আমার প্রথম ইনভেস্টর। এরপর শুরু হয় ম্যাটেরিয়ালের সোর্সিং। প্রায় সবাই খাদি বলতে কুমিল্লাকেই জানে। কিন্তু আমি নতুন কিছু খুঁজছিলাম যা সচরাচর প্রচলিত নয় কিন্তু দেশের অতিহ্য বহন করে। সারাদেশ ঘেঁটে খুঁজে পেলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের খাদি। এরপর চলে কর্মী বাহিনী তৈরি। সব শেষে যাত্রা শুরু করে আমার “নিথান”।

প্রতিবেদকঃ আপনার উদ্যোগের পিছনের কারন কি?
ফারাহ্: মূল কারণ ছিল আত্মপরিচয় অনুসন্ধান ও নিজের অবস্থান তৈরি। আর এই ভাবনার অনেক অনুঘটক আছে। বাস্তব জীবনের অনেক কঠিন চিত্র, প্রয়োজন আমাকে উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করেছে। আমি গর্বের সাথে বলতে পারি, আমি রিসেলার নই একজন উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী। সব উদ্যোক্তাই ব্যবসায়ী। কিন্তু সব ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা নয়।

প্রতিবেদকঃ আপনি কি কি সেবা নিয়ে কাজ করছেন?
ফারাহ্: আমার উদ্যোগের শুরুটা ছিল শুধু মাত্র মেয়েদের তৈরি পোশাক নিয়ে। ক্রেতা চাহিদার উপর ভিত্তি করে বাচ্চাদের পোশাকও তৈরি শুরু করি। প্রায় এক বছর শেষে আমার উদ্যোগ এখন একটা সম্পূর্ণ লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। পোশাকের সাথে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ফ্যাশন এক্সেসরিজ। ওয়েবসাইট নির্মাণের কাজ চলছে। ইচ্ছা আছে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা দেবার।
মান সম্মত হ্যান্ড এমব্রয়ডার্ড পোশাক বা ফ্যাশন এক্সেসরিজ মানেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। দেশের পণ্য দেশবাসীর জন্য হোক সুলভ, বহির্বিশ্বের জন্য হোক একসপেন্সিভ — এটাই আমার মূল লক্ষ্য।

প্রতিবেদকঃ একজন নারী উদ্যোক্তার কি কি বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং তা কিভাবে সমাধান করা যায়?
ফারাহ্: প্রথম বাঁধা প্রশ্নের মাঝেই রয়েছে। আমাদেরকে উদ্যোক্তা নয়, “নারী উদ্যোক্তা” সম্বোধন করা হয়। সব বাঁধার জন্ম এই ব্যবধানের মাঝে। এবং সম্ভবত এটা অসমাধান যোগ্য সমস্যা। তবে নারীরা এই সমস্যাকে মানতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করেছে। এটা দারুন আনন্দের। যদিও এতে করে আমাদের কাঁধে কাজ এবং দায়িত্বের ভার কয়েকগুন বেড়ে গেছে।
এই সমস্যার প্রাথমিক সমাধান রয়েছে পরিবারের মাঝে। প্রতিটা পরিবার যদি মেয়েদের দক্ষতা, যোগ্যতা ছেলেদের সমান ভাবতে পারে, সাপোর্টিভ হয় তবে সমাজ বদলাতে সময় লাগবে না। দ্বিতীয়তঃ সরকারি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। যেহেতু নারীদের পুঁজির ঘাটতি অনেক বড়ো একটা বাঁধা উদ্যোক্তা হবার জন্য। প্রয়োজন পর্যাপ্ত কারিগরি, প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়িক শিক্ষা।
আমাদের সমাজে এই সমস্যার মূল এতো গভীরে প্রোথিত যে এই স্বল্প পরিসরে সমস্যার ব্যাখ্যা এবং সমাধান খোঁজা সম্ভব নয়।

প্রতিবেদকঃ আপনার উদ্যোগ নিয়ে আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
ফারাহ্: “নিথান” কে আমি পরিপূর্ণ রূপে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডে পরিণত করতে চাই। দেশের বাজার জয় করে উন্মুক্ত বিশ্ব বাজারে আমার উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের নামের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। প্রতিটা পণ্যে সম্ভাব্য সব ম্যাটেরিয়াল দেশ থেকেই সংগ্রহ করতে চাই। কিছু সীমাবদ্ধতা তো থাকবেই। এটা সার্বজনীন। একদিন দেশী পণ্যের বিশাল স্বয়ং সম্পূর্ণ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে। সেদিন সেই ইন্ডাস্ট্রির গর্বিত অংশ হতে চাই।

আমার উদ্যোক্তা জীবনের যাত্রা শুরুর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ "উইমেন অ্যান্ড ইকমার্স ফোরাম (উই)। সব সিদ্ধান্ত, প্রস্তুতি গ্রহণ করে যখন বিজনেস প্ল্যান নিয়ে ভাবছি তখনই পুরো পৃথিবীকে অবরুদ্ধ করে দেয় কোভিড -১৯। এতোটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে, প্রায়ই মনে হতো এটাই বুঝি জীবনের শেষ প্রান্ত। ঠিক সেই মুহূর্তে উইয়ের সাথে যুক্ত হই। আচমকাই অনুভব করলাম পথ তৈরি হচ্ছে। আমি চলতে শুরু করেছি। পরের টুকু আজকের আমি। আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাতে চাই উই এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপু এবং উপদেষ্টা রাজিব আহমেদ ভাইয়া কে। এই দুজন মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের "উই"। যেখানে আমার মতো হাজারো উদ্যোক্তা প্রতিদিন সামনে এগিয়ে চলেছেন।

RedLive

Related post