বাঙালির নব আনন্দের উৎস: পহেলা বৈশাখের ইতিহাস

 বাঙালির নব  আনন্দের উৎস:  পহেলা বৈশাখের ইতিহাস

পান্তা-ইলিশ কিংবা হরেক রকমের ভর্তা, সাদা-লাল শাড়ি-পাঞ্জাবির সাজ, রঙ-বেরঙের পোস্টার, ফেস্টুন ও মুখোশ, মাটির কাঠ-বেতের খেলনা,গৃহস্থালী সামগ্রী, নাগরদোলা – এই শব্দগুলো আমাদের বাঙালিদের কাছের খুবই পরিচিত। যেন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে আবহমান কাল ধরে মিশে আছে। উপরের উল্লেখিত শব্দগুলো একত্রিত করলে যে দৃশ্যটি ভেসে উঠবে তা হলো ‘পহেলা বৈশাখ’

পহেলা বৈশাখ নিয়ে কিছু কথা :

পহেলা বৈশাখ মানেই বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বাঙালির বর্ষবরণ। সূর্য পরিক্রমণের একটি চক্র পূর্ণ করে পৃথিবীর আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই আবর্তনের ধারা অব্যাহত আছে বলেই পৃথিবীর চিরপুরাতন হয়েও আমাদের কাছে চিরনতুন। আজ বাঙালির সেই চিরনতুনের শুভাযাত্রাকে স্বাগত জানাবার দিন। যদিও বিগত বছরে করোনা মহামারীর কারণে বর্ষবরণে কোনো আড়ম্বরতা ছিল না। পরিস্থিতি এবারও পরিবর্তন না হওয়ায় থাকছে না উদযাপনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা। তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক নববর্ষ বাঙালি জাতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে জড়িত সেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তাঁদের সংস্কৃতির ধারাকে উজ্জীবিত করে এবং এদেশের লোকজ সমৃদ্ধ ইতিহাসকে আজও তুলে ধরে। তাইতো, করোনার ঘরবন্দী জীবনে সাধ-সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব জীবনের সকল জীর্ণ, পুরোনো জঞ্জালকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন বছরকে আহবান করছে এক নতুন প্রত্যাশায়। পহেলা বৈশাখের সূর্যতপ্ত সকালে আমাদের মর্মস্পর্শ করে কবিগুরুর আহবান –

” এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥

যে বাংলা নবর্বষ নিয়ে এত ঐতিহ্য, আনুষ্ঠানিকতা, আনন্দ উৎসব সেই নবর্বষ কি করে এলো? ইতিহাস কি চলুন জেনে নেয়া যাক!

শুরুর ইতিহাস এবং বাঙালির চেতনায় প্রবেশ : বাঙালি জাতির জন্ম ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার সভ্যতা,সংস্কৃতির, লোকাচার, উৎসব, পার্বণ সবই কৃষিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলা সনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো।

মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। রাজকার্য সম্পাদনে হিজরি সাল নিয়ে কিঞ্চিৎ অসুবিধার সৃষ্টি হলে তিনি বঙ্গদেশের জন্য পৃথকভাবে বাংলা সন সৃষ্টির নির্দেশ দেন। এই সন প্রবর্তনের নির্দেশ দেন কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার দিকে লক্ষ করে। তৎকালীন সময়ে বাঙালি কৃষকরা অগ্রহায়ণ মাসকে নবান্ন উৎসবে বাঙলা সনের প্রথম মাস ধরা হতো। রাজসভার নবরত্নের বাইরে দশম রত্ন আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একটি নীতি নির্ধারন করেন। এ নীতিতে বলা ছিল মাঠে বীজ বপনের প্রথম থেকে বছরের শুরু হবে এবং ফসল ওঠা শেষ হলে বর্ষের সমাপ্তি ঘটবে। এ নীতির প্রয়োগ অনুযায়ী বৈশাখ থেকে তিরিশে চৈত্র পর্যন্ত বাংলা সন চালু করা হয়। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

তখন প্রত্যেকে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার বর্ষবরণে প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। হিসাব-নিকাশ, দেনা পরিশোধ, খাজনা পরিশোধসহ যাবতীয় হিসাব সংরক্ষণের জন্য হালখাতা তৈরি করা হতো।

তবে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বর্তমান বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন ঠিক কবে শুরু হয়েছিল সে নিয়েও রয়েছে এক ইতিহাস। যতদূর জানা যায়, আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ষাটের দশকে রমনার বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত ‘এসো হে বৈশাখের’ গণসংগীতের সূচনা হয়। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

অবাঙালির বৈশাখ বরণ:

নববর্ষ মানেই আনন্দ, হাসির খেলা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মানুষজন বছরের এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। নানা আয়োজনের মাধ্যেম নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে যখন নববর্ষ উৎযাপিত হয়, প্রায় একই সময় ভারতের কয়েকটি রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ছাড়াও মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ক্যাম্বোডিয়া, নেপাল, থাইল্যাল্ডে উৎযাপিত হয় নববর্ষ। বাংলাদেশে কিভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয় সেটা আমরা সবাই জানি। চলুন এবার বাংলাদেশের নবর্বষের সময়ের সাথে মিল রেখে কিছু দেশের নববর্ষ উদযাপন সম্পর্কে জেনে আসি।

রাঙ্গলি বিহু:

আসামের নববর্ষ উৎসব এটি৷ ১৪ কিংবা ১৫ এপ্রিল এটি উদ্যাপিত হয়৷ রাঙ্গলি বিহুর একটি অংশ ‘গরু বিহু’৷ গরু যেহেতু কৃষকের জীবিকা আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাই এই সময় গরুকে গোসল করিয়ে (ছবি) তার পূজা করা হয়৷ এছাড়া সেসময় রঙের খেলা আর নাচ-গানেরও আয়োজন থাকে৷

সংক্রান :

প্রতিবছর এপ্রিলের ১৩ তারিখ থাইল্যান্ডে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়৷ তবে ১৪ ও ১৫ তারিখেও ছুটি থাকে৷ পানি ছিটিয়ে একে-অপরকে ভিজিয়ে দেয়া এই উৎসবের একটি অংশ৷ অনেক থাই নাগরিক এই ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বয়স্কদের সঙ্গে দেখা করেন৷

আলুথ অভুরুদ্দ:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মতো শ্রীলংকাতেও ১৩ কিংবা ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপিত হয়৷ গরুর গাড়ির দৌড় (ছবি) এই উৎসবের একটি অংশ৷

থিনজান:

মিয়ানমারের নববর্ষ উৎসব৷ এপ্রিলের মাঝামাঝি এটি পালিত হয়৷ পানি নিয়ে খেলা এই উৎসবের একটি বড় অংশ৷ চার-পাঁচদিন ধরে চলা এই উৎসবে তরুণ-তরুণীরা নাচে-গানে মেতে উঠেন৷

চউল চনাম থিমে:

কম্বোডিয়ার নববর্ষ৷ সাধারণত ১৩ কিংবা ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়৷ তবে ছুটি থাকে তিনদিন৷ সংক্রান আর থিনজানের মতো পানি খেলা এই উৎসবেরও মূল আকর্ষণ৷ এই সময় ঘরে ঘরে বিশেষ খাবারও রান্না করা হয়৷

বর্তমানে আমরা করোনা মহামারীর কঠিন সময় পার করছি। কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বর্ষণবরণ করা হবে। নবর্বষের উৎসব ঐতিহ্যের ধারা বেয়ে পালন করা সম্ভব হবে না। তবুও আমরা আশা রাখি, গ্রীষ্মের অগ্নিদাহে শুচি হয়ে ধরনী ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক চাঞ্চল্য, ঘুচে যাবে সমস্ত ঝড়া। ঘরে থেকেই হোক বর্ষবরণ। সকলকে নবর্বষের শুভেচ্ছা। নবর্বষের নতুন সূর্যালোককে সাক্ষী রেখে আগামী দিনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হোক!

লিখেছেনঃ বৃন্তি সাহা

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।