বিজনেস শুরুর পূর্বে বিজনেস আইডিয়া নিয়ে এনালাইসিস করা উচিত- উদ্যোক্তা মুনির হোসাইন

 বিজনেস শুরুর পূর্বে বিজনেস আইডিয়া নিয়ে এনালাইসিস করা উচিত- উদ্যোক্তা মুনির হোসাইন

করোনা ভাইরাস মহামারীর শুরু হতেই শহরাঞ্চলের মানুষ সহ অনেকের মধ্যেই বাজার যাওয়া এসব কাজে অনীহা কিংবা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও মানুষের কর্ম ব্যাস্ততায় গরুর হাটে গিয়ে গরু কেনা কিংবা বাজার গিয়ে গোশত কেনার প্রবনতা ও কমছে।এছাড়াও রয়েছে অসাধু ব্যাবসায়ী ও দালাল দের ঠকানোতে মানুষ নিজে থেকে এসবে অনীহা ও কাজ করছে।ফলশ্রুতিতে অনলাইনে গরু বেচাকেনা কিংবা গোশত বিক্রি মানুষের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসছে। এমনই একটি উদ্যোগ নিয়ে কথা বলছি চট্টগ্রামের মুনির হোসাইন এর সাথে। তার স্টার্ট আপ “Ready Meat BD” গড়ে তারা দুই ভাই সফল।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রেড লাইভ এসিস্ট্যান্ট অফ কমিউনিকেশন অফিসার সাদিয়া ইসলাম মীম

আপনার সম্পর্কে জানতে চাই?

আমি মোহাম্মদ মুনির হোসাইন। হোম ডিস্ট্রিক্ট চট্টগ্রাম হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার মোহাম্মদপুরে। মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেছি ২০১৬ সালে। ৫ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বর্তমানে মোহাম্মদপুর এই থাকি এবং এখান থেকেই আমাদের উদ্যোগ ‘Ready Meat BD’কে পরিচালিত করছি। Ready Meat BD আমাদের দুই ভাইয়ের সম্মিলিত স্টার্ট আপ৷ কাজ করছি “রেডিমিট বিডি’র” চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) হিসেবে। সাথে আছেন রেডিমিট বিডি’র সত্ত্বাধিকারী ও চেয়ারম্যান মোঃ শেখ রহমত উল্লাহ।

কিভাবে আপনার উদ্যােগ টি শুরু করেছেন?

যে কোনো উদ্যোক্তার জন্য তাঁর উদ্যোগের শুরুর পথটা সহজ হয় না। উদ্যোগের শুরুতে উদ্যোগের পণ্য ঠিক করা, পণ্যের সোর্সিং, কোয়ালিটি নিশ্চিত করা, প্যাকেজিং, ডেলিভারি ইত্যাদি বিষয়ে তেমন জানা থাকে না। এসব কারণে ব্যবসার শুরুটা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের উদ্যোগ Ready Meat BD যাত্রা শুরু করে ২০২০ সালে৷ রেডিমিট বিডি’কে পরিচিত করাতে আমরা কুরবানী ঈদকে টার্গেট করে “কুরবানী প্রজেক্ট” হাতে নিই। কুরবানী প্রজেক্টে আমরা মার্কেটিং, ডিজাইনিং, প্যাকেজিং এমন কী সোর্সিং নিয়েও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি। উপস্থিত বুদ্ধি আর ধৈর্য্যের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি সফল কুরবানী প্রজেক্ট সমাপ্ত করেছি আমরা। কুরবানী প্রজেক্ট আমরা ২১টি খাসী নিয়ে শুরু করি যার মধ্যে ১৭টি খাসী ঈদের দিন কুরবানী দিয়ে প্রসেস করে ক্রেতার বাসায় হোম ডেলিভারি দিয়েছি। কুরবানী প্রজেক্ট ছিল আমাদের পরিচিতি বাড়ানোর পদক্ষেপ৷ সেপ্টেম্বর মাস থেকে আমরা পুরোদমে Ready Meat BD এর রেগুলার কার্যক্রম শুরু করি।

আপনার উদ্যোগের পিছনের কারন কি?

শহরের মানুষদের মধ্যে ফ্রেশ, তাজা পণ্য না পাওয়ার একটা আক্ষেপ থাকে। আর সেটা যদি কাঁচা পণ্য বিশেষ করে মাংসজাত পণ্য হয় তাহলে সেটি হালাল এবং ফ্রেশ হওয়াটা জরুরী। তাছাড়া অনেক অসাধু ব্যবসায়ী গরুর বদলে মহিষ, খাসীর বদলে ছাগী বা ভেড়ার গোশত দিয়ে থাকে। পাশাপাশি পানিতে ভিজিয়ে ওজন বাড়িয়ে অনেকেই গোশত বিক্রি করে। এই ভেজালের মাঝে শহরের মানুষকে ফ্রেশ, হালাল এবং অর্গানিক গোশত সরবরাহ করে গোশতের আসল স্বাদ সকলের কাছে পৌছে দেওয়াটাই আমাদের উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য।

গোশত কিনে প্রসেস করা, বাজারে যাওয়া আসার সময় ব্যয় ও পরিবহন খরচের ঝামেলা এবং দুঃশ্চিন্তা থেকে ক্রেতাদের মুক্ত রাখার জন্যই কাঁচা গোশতের মত চ্যালেঞ্জিং একটা পণ্য নিয়ে কাজ করছে রেডিমিট বিডি।

আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা কে দিয়েছেন?

যে কোনো কাজে সফল হতে হলে, এগিয়ে যেতে হলে অনুপ্রেরণা-সাপোর্ট অনেক বেশি দরকার। এপ্রিসিয়েশিন পেলে কাজের আগ্রহ তৈরি হয়। আর প্রতিদিন কাজ করার মাধ্যমে সফলতার রাস্তা তৈরি হয়।

যে কোনো কাজে সফল হতে হলে, এগিয়ে যেতে হলে অনুপ্রেরণা-সাপোর্ট অনেক বেশি দরকার। এপ্রিসিয়েশিন পেলে কাজের আগ্রহ তৈরি হয়। আর প্রতিদিন কাজ করার মাধ্যমে সফলতার রাস্তা তৈরি হয়।

২০২০ সালে প্রায় একই সময়ে উইমেন এন্ড ই-কমার্স (উই) এবং ডিজিটাল স্কীল ফর বাংলাদেশ (ডিএসবিতে) যুক্ত হই৷ সেখানে রাজিব আহমেদ স্যারকে চিনেছি। ই-কমার্স রিলেটেড স্যারের প্রতিটি পরামর্শ, আইডিয়া আমার উদ্যোগে দারুনভাবে কাজ করেছে। আমার উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্যারের পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণা অনেক বেশি।

কি সেবা অথবা পণ্য নিয়ে কাজ করছেন?

আমাদের উদ্যোগের নাম হচ্ছে রেডিমিট বিডি। নাম থেকেই ধারণা করা যায় আমরা মিট নিয়ে কাজ করি। তবে আমাদের বিশেষত্ব হচ্ছে আমরা রেডি টু কুক হালাল, অর্গানিক এবং ফ্রেশ গোশত নিয়ে কাজ করি যা কোনো ধরনের কাটা-ধোয়ার ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি রান্না করা যায়। আমরা গরু, মুরগি ও খাসীর গোশত ক্রেতার চাহিদামত রেডি টু কুক হিসেবে হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকি। গরুর গোশতের বোন ইন এবং বোনলেস গোশতের পাশাপাশি রয়েছে গরুর ভুঁড়ি, পায়া, মগজ, কলিজা, মাথার গোশত ইত্যাদি। এখন পর্যন্ত আমাদের সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য হচ্ছে গরুর ভুঁড়ি৷

আমাদের সিগনেচার প্রোডাক্ট হচ্ছে খাসীর গোশত৷ খাসীর গোশতের পাশাপাশি আছে খাসীর কলিজা, মাথা, পায়া ইত্যাদি।

আমরা রেডি টু কুক মিট সার্ভিসে নতুন ভ্যালু বা সেবা যোগ করেছি। সাধারণত এক কেজির একটা মুরগি প্রসেস করার পর ৫৫০-৬০০ গ্রাম গোশত পাওয়া যায় যা মূল এক কেজির থেকে প্রায় ৪০০-৪৫০ গ্রাম কম। আমরা এই গ্যাপটা পূরণ করে ক্রেতাকে পূর্ণ এক কেজি রেডি টু কুক গোশত সরবরাহ করে থাকি। অর্থাৎ ক্রেতা এক কেজি হিসেবে পূর্ণ এক কেজি পণ্যই পাবেন।

আমরা কোনো ফ্রোজেন পণ্য সরবরাহ করি না, পণ্যের কোয়ালিটিতে কোনো কম্প্রোমাইজ করি না।

একজন উদ্যোক্তার কি কি বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং তা কিভাবে সমাধান করা যায়?

উদ্যোক্তা জীবন সবসময় চ্যালেঞ্জিং। নতুন উদ্যোগ শুরুর আগে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। বিজনেস আইডিয়া, কিভাবে বিজনেস ডেভেলপ করা যায়, মার্কেট এনালাইসিস, কাস্টমার সেগমেন্টেশন, বিজনেস প্লান ইত্যাদি জানতে হয়। এছাড়া রয়েছে কন্টেন্ট রাইটিং, মার্কেটিং কন্টেন্ট তৈরি, ট্রেন্ড এনালাইসিস, ফটোগ্রাফি এবং ডিজাইনিং এর

একজন উদ্যোক্তার কি কি বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং তা কিভাবে সমাধান করা যায়?

উদ্যোক্তা জীবন সবসময় চ্যালেঞ্জিং। নতুন উদ্যোগ শুরুর আগে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। বিজনেস আইডিয়া, কিভাবে বিজনেস ডেভেলপ করা যায়, মার্কেট এনালাইসিস, কাস্টমার সেগমেন্টেশন, বিজনেস প্লান ইত্যাদি জানতে হয়। এছাড়া রয়েছে কন্টেন্ট রাইটিং, মার্কেটিং কন্টেন্ট তৈরি, ট্রেন্ড এনালাইসিস, ফটোগ্রাফি এবং ডিজাইনিং এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয় গুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন না করে যে কোনো বিজনেস স্টার্ট করাটা কঠিন।

উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ থাকবে কোনো বিজনেস আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরুর আগে মিনিমাম ৬ মাস সেই বিজনেস আইডিয়া বা পণ্য নিয়ে পড়াশুনা করা, বিজনেস আইডিয়া এনালাইসিস করা৷ এই গ্রুপে একজন উদ্যোক্তার দরকারী সব তথ্যই বাংলা ভাষায় পাওয়া যায়। শুধু দরকারী তথ্য সার্চ করে খুঁজে বের করতে হয়।

উদ্যোক্তার শক্তি হচ্ছে তার পড়াশুনা। নিয়মিত সময় দিয়ে পড়াশুনা করলে খুব সহজেই নিজের বিজনেস আইডিয়া ডেভেলপ করা যায়৷ পাশাপাশি নিজের পারসোনাল ব্র‍্যান্ডিংও স্ট্রং করা যায়। তাই উদ্যোক্তাদের বলবো কাজ শুরুর আগে পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে।

উদ্যোগ নিয়ে আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

আমরা আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে বছর ভিত্তিক ভাগ করে নিয়েছি। এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর ও দশ বছর হিসেবে ব্যবসার পরিকল্পনা করছি।

আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের মানুষদের কোয়ালিটি পূর্ণ গোশতের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের সিগনেচার প্রোডাক্ট খাসীর গোশত মধ্যপ্রাচ্য এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের (আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক) দেশগুলোতে রপ্তানি করা। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলে পড়তে যায়। তারা যেন নিশ্চিন্তে হালাল এবং ফ্রেশ গোশত খেতে পারেন সেটাই আমাদের চাওয়া।

আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন উদ্যোক্তার জন্য তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ?

করোনাকালীন সময়ে একদিকে মানুষ যখন চাকরি হারাচ্ছে অন্যদিকে তখন পরিবারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য হোক বা পরিস্থিতি মোকাবেলায় হোক, আমাদের দেশে অনেক উদ্যোক্তার আবির্ভাব হয়। কেউ শখে, কেউবা আবার পেশা হিসেবেই উদ্যোক্তা জীবন বেছে নিয়েছেন। প্রত্যেকেই বাহবা পাওয়ার যোগ্য।

শুধু বাংলাদেশ না, যে কোনো দেশের প্রেক্ষিতেই উদ্যোক্তার জন্য তাঁর উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া সহজ না। উদ্যোক্তা জীবন যেমন চ্যালেঞ্জিং ঠিক সেভাবে উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও বেশ কষ্টসাধ্য। একজন উদ্যোক্তাকে ঘরে-বাইরে সবদিকে সময় দিতে হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের নারী উদ্দ্যোক্তারা কঠিন সময় পার করছেন। সংসারের যাবতীয় কাজের পাশাপাশি উদ্যোগে সময় দেওয়া, ক্রেতার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহ প্রোডাক্ট সোর্সিং, প্যাকেজিং, ডেলিভারি সব প্রায় একাই করছেন।

একটা স্টার্টআপ দাঁড় করাতে সব উদ্যোক্তাকেই কষ্ট করতে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকের মাধ্যমে যদি উদ্যোক্তাদের সহজ শর্ত এবং কম ইন্টারেস্টে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হয় তাহলে উদ্যোক্তারা আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারবে।

তাছাড়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রেড লাইসেন্স, TIN নাম্বার, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ বিভিন্ন লিগ্যাল ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়। এসব সার্ভিসের জন্য যদি সরকারের পক্ষ থেকে “ওয়ান স্টপ সার্ভিস” চালু করা যায় যেখান থেকে প্রয়োজনীয় সব লিগ্যাল ডকুমেন্টে তৈরি করা যাবে তাহলে উদ্যোক্তাদের কাজ সহজ হবে।

উদ্যোক্তাদের হাত ধরে দেশের ইকোনমি দারুনভাবে বুস্ট করছে। অনলাইন কেনাকাটায় মানুষ আগ্রহী হচ্ছে, অভ্যস্ত হচ্ছে। দেশের ই-কমার্সকে গুরুত্ব দিলে, উদ্যোক্তাদের কাজ সহজ করলে দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে।

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।