সফল নারী উদ্যোক্তা পিরোজপুরের জুঁই ইসলাম

 সফল নারী উদ্যোক্তা পিরোজপুরের জুঁই ইসলাম

জীবন মানেই সংগ্রাম।এমনটা হয়ত আমরা সবাই মানতে রাজী।সবার সংগ্রামই আলাদা। সবার স্বপ্ন আর চাহিদা আলাদা।শুধু পুরুষ দের জন্য এটি এমন নয়,নারীদের ও পেরুতে হয় নানা সংগ্রাম।সেটি যখন একজন উদ্যোক্তা তখন আরো বেশি।আজ আমরা জানব এমন একজন নারী কে নিয়ে যিনি নিজের পড়াশোনার দিন থেকেই করে গেছেন সংগ্রাম, সম্মুখীন হয়েছেন বিভিন্ন বাধা বিপত্তির।বেকার অভিশাপ থেকে নিজেকে করে তুলেছেন সফল উদ্যোক্তা। কথা বলছি “Dreamup Entrepreneur” এর ফাউন্ডার ও বাঙালির অনুষ্ঠান এবং De Shop এর উদ্যোক্তা পিরোজপুরের জুঁই ইসলাম কে নিয়ে।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মিরপুরের প্রতিনিধি জান্নাতুল ফেরদৌস।

আপনার সম্পর্কে জানতে চাই?

আমি জুঁই ইসলাম। নারী হিসেবে এখন আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন উদ্যোক্তা। অন্য আর একটা বড় পরিচয় সেটা হলো ফেইসবুকে ই-কমার্স সম্পর্কিত Dreamup Entrepreneurs (DE) এর ফাউন্ডার এবং এডমিন। আমার পড়াশোনা এবং চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে সংগ্রাম করেছি সে সম্পর্কে আজ লিখব।

আপনার পড়াশোনা ?

আমি পিরোজপুর জেলার মেয়ে। বরিশাল বিভাগ থেকে এসএসসি ২০০৭ এবং এইচএসসি ২০০৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগে পাশ করি। ২০০৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে আমার পরিবারের সাথে পিরোজপুর থেকে ঢাকার মিরপুরে বসবাস করতে শুরু করি ।যেহেতু আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সেহেতু নিজে কিছু করে পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মন স্থির করি। ২০০৯ সালে সেপ্টেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে ঢাকা এসেই অক্টোবর মাসে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পার্ট টাইম জব করি। ২০১০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরপুর কলেজ, ঢাকায় ইংরেজি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই। অতঃপর সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত নিয়মিত ক্লাস করি এবং দুপুর দুইটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অফিস করে স্টুডেন্ট পড়ায়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজতো। রুটিন বদ্ধ জীবন এভাবেই চলতে থাকলো। কঠোর পরিশ্রম এর মাধ্যমে চাকরির পাশাপাশি ইংরেজি বিষয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে অনার্স এবং মাস্টার শেষ করি।

গ্র‍্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়টা নারী হিসেবে কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? নারী হিসেবে বেকার সময় টা কতটা কঠিন?

অনেকটাই।মাস্টার্স কম্পিলিট করে প্রাইভেট চাকরির পাশাপাশি কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করি। একই সাথে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। হঠাৎ করে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। গতবছর ২০২০ সালের করোনা মহামারির প্রকোপ ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়তে শুরু করে। মার্চ মাসে আরো বেশি আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ, ২০২০ সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। একদিকে প্রাইভেট চাকরি হারিয়ে নিরুপায় অন্যদিকে সরকার কর্তৃক কোচিং বন্ধ ঘোষণা করাতে ক্লাসও নিতে পারছি না । এক কথায় বলতে গেলে উপার্জন করার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়ে আমার বাহিরে চিন্তা করলে চারিদিকে ভয়ংকর এবং থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর মিছিলে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল।দীর্ঘ ১১ বছর পর যখন ঘরে বসে থাকি মনে হচ্ছিলো সব কিছু থমকে গেছে। একটা হতাশা নিজের মধ্যে ভর করতে থাকে। দম আটকে যাচ্ছিলো।

উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা কিভাবে?

প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেইসবুককে কাজে লাগানোর চিন্তা মাথায় আসে। অতঃপর মে মাসের দিকে আমার এক রাজশাহীর ফ্রেন্ড এর কাছ থেকে বাসার জন্য আম অর্ডার করি। পরবর্তীতে আমার ফ্রেন্ড আমার ঠিকানা বরাবর আম পৌঁছে দেয়। সেই সাথে আমার পরিচিতজনদের কাছে ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার সংগ্রহ করতে বলে। আমিও তার প্রস্তাবে রাজি হই। আলহামদুলিল্লাহ প্রায় ১৫০-২০০ কেজি আম বিক্রি করি। নিজে থেকে কিছু করার সাহস পাই এবং আমার পরিবারের সবাই উৎসাহ প্রদান করে। তখন থেকেই উদ্যোক্তা জীবনের পথচলা শুরু হয়।

করোনাকালীন সময়টা ব্যাবসায়ে প্রভাব কেমন?

এই করোনাকালীন সময়েই ই-কমার্স কে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। ঘরে বসে অনলাইনে কিছু করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকি। অতঃপর ফেইসবুক পেইজ খুলে আমি এবং আমার বড় বোন নিতু কবির মিলে গায়ে হলুদের গহনা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গহনা তৈরির কাজ শুরু করি। আলহামদুলিল্লাহ অল্প সময়ে ব্যাপক সাড়া পাই। গহনার পাশাপাশি অন্য একটা নতুন পেইজ De Shop খোলা হয়। যার পেজ লিংকঃ https://www.facebook.com/deshop.jui/। এই পেজে নতুন সংযোজন করা হয়েছে টাংগাইলের বিভিন্ন প্রকার শাড়ি এবং কুমিল্লার বিখ্যাত খাদি পাঞ্জাবি। ছোট উদ্যোগ থেকে নিজে এখন বড় কিছুর করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছি।

উদ্যোক্তা হতে গিয়ে কার সাপোর্ট পেয়েছেন বেশি?

উদ্যোক্তা হতে গিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছি আমার বড় বোন শেখ নিতু কবির এর কাছ থেকে। আমার উদ্যোক্তা হওয়ার পুরোটা ক্রেডিট আমার বোন পায় কারন আমি যখনই হতাশ হয়েছি তখন আমাকে নিজে থেকে কিছু করার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এছাড়াও আমাদের আমার বড় ভাই মোঃ আরাফাত কবির, আমার পরিবারের মা, বাবা এবং আমার এক ফ্রেন্ড সবোর্চ্চ সাপোর্ট করেছেন। তাদের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা আমি আজ নিজেকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করি।

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমার অনেক ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে। নিজে যখন উদ্যোক্তা হই তখন আমার আশে পাশের নারীদের জন্য কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। গতবছর নভেম্বর মাসে Dreamup Entrepreneurs (DE) নামে একটি গ্রুপ তৈরি করি। আমি খুব সুন্দর করে গ্রুপটি পরিচালনা করতে শুরু করি। দৈনিক প্রায় ১১-১২ ঘন্টা গ্রুপের পিছনে সময় দেওয়া শুরু করি। আস্তে আস্তে মেম্বার বাড়তে বাড়তে বর্তমানে মেম্বার প্রায় তিন হাজার পাচঁশত যেখানে রয়েছে প্রায় এক দেড় হাজার উদ্যোক্তা।

“Dreamup Entrepreneurs ” গ্রুপটি নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইব।

এখানে বেশিরভাগ- ই নারী উদ্যোক্তা। প্রত্যেক উদ্যোক্তা তার পণ্যের গুনগত মান ঠিক রেখেছে। এ পর্যন্ত গ্রুপ থেকে যত বেচা-বিক্রি হয়েছে গ্রাহক সবগুলো পণ্যের পজিটিভ রিভিউ দিয়েছে। যার ফলে গ্রুপটি ছোট হলেও কেনাবেচার বিশ্বস্ত প্লাটফর্ম হিসেবে দাঁড়াচ্ছে । এই গ্রুপের মাধ্যমে সবার মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়। সাথে সাথে প্রত্যেক উদ্যোক্তা তাদের নিজ নিজ পণ্যের পরিচিতি সবার সামনে তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। গ্রুপ থেকে আলহামদুলিল্লাহ প্রতিদিন অনেকগুলো পণ্য বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে একে অপরের ক্রেতা বিক্রেতা হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করছে। “আমরাই নারী আমরাই পারি” এই স্লোগানকে সফল করার জন্য এবং ছোট ছোট ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু করার মানুষিকতা থেকে Dreamup Entrepreneurs (DE) গ্রুপকে বড় করার জন্য প্রতিনিয়ত নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি নারী যেন নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে পারে এবং আত্মনির্ভরশীল হতে পারে সেই জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আর্থিকভাবে এই সব ক্ষুদ্র নারীদের সহায়তা প্রদান করতে না পারলেও মানুষিকভাবে উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছি যেন নিজে কিছু উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে পারে। ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক কিছু করতে চাই তাদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলে চাই। ওইদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন প্রতিটি ঘরে ঘরে একজন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

ভবিষ্যৎ নারী উদ্যোক্তা দের জন্য কোনো পরামর্শ?

সমস্ত নারীদের উদ্দেশ্য বলতে চাই নিজেদের ভিতরের সুপ্ত প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সাহস সঞ্চার করে সমস্ত ভয় ভীতি উপেক্ষা করে নিজে থেকে কিছু করার উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। আপনি যে কাজেই পারদর্শী সেই কাজ দিয়ে শুরু করুন এবং নিজের সবোর্চ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। কঠোর পরিশ্রম, সততা এবং ধৈর্য ধারণা করে কাজে এগিয়ে যেতে হবে। প্রথমে প্রতিদিনের কর্ম পরিকল্পনা এবং গোল সেট করুন তারপর সাপ্তাহিক এবং অতপর মাসিক টার্গেট সেল করে সেটা পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করুন ইনশাআল্লাহ ভালো সুফল পাবেন। প্রতিদিনের কাজ এমনভাবে করতে হবে যেন দিন শেষে নিজেই নিজেকে বলতে পারি- “আমার কাজে আমিই চ্যাম্পিয়ন” পরিশেষে বলতে চাই পরিশ্রম করে যেতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত সফলতা না আসে। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি এবং দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারি। সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।

Kazi Naima Ferdousi

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।