স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং পূর্বের ইতিহাস এক নজর

 স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং পূর্বের ইতিহাস এক নজর

“স্বাধীনতা তুমি পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।”

স্বাধীনতা শুধু একটি শব্দ নয়। বরং স্বাধীনতা একটি শিহরণ। একটি জাগরণ। একটি আনন্দ-বেদনার জ্বলন্ত ইতিহাস।

পৃথিবীর প্রতিটি জাতিই স্বাধীন হতে চায়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে নিজেকে বন্দি করে রাখতে কেউ চায় না। তবে – এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শত শত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়। বাঙালির জাতিরও রয়েছে সুদীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এক অগ্নিঝড়া স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ উন্মোচিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা। আবার, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের কালসীমার ভেতরে রয়েছে পুরান পাথরের যুগ, নতুন পাথরের যুগ। তাম্র-প্রস্তর যুগ। প্রাচীন যুগ তথা ঐতিহাসিক যুগের শুরু হয়েছিল বাংলায় আর্য-মৌর্য ও গুপ্ত শাসনের প্রবতর্নের মাধ্যমে। আরও রয়েছে পাল, সেন, সুলতানী, পাঠানদের শাসনামল। তাছাড়া রয়েছে মুঘল ও ইংরেজদের শাসনামলের যত কথা। ইতিহাসের এত শত ধাপ পেরিয়ে – অতঃপর সুদীর্ঘ ২৩ বছরের স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসনের অন্যায়, অবিচার ও শোষনের অধ্যায় শেষ হয়েছিল নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ফলে আমরা অর্জন করি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্জনের পথ মোটেও সহজ ছিল না। এর জন্য লক্ষ, লক্ষ বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কতটুকু আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি তা কবি শামসুর রাহমাম এর একটি কবিতা থেকে উপলব্ধি করতে পারি।

“তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর। তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো দানবের মত চিৎকার করতে করতে তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা, ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো।”

দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। তবে কথায় আছে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন ‘। স্বাধীনতা অর্জন হলো ঠিকই, কিন্তু সারা দেশে রয়ে গেলো শোষনের ক্ষতচিহ্ন। পাকিস্তানিরা যুদ্ধের সময় ‘পোড়া মাটির নীতি’ অনুসরণ করেছিল। অর্থাৎ, তারা যদি পরাজিত হয়ে এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, তাহলে যাওয়ার আগে সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যাত্রা ছিল নানাভাবে কণ্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল। পাশাপাশি ছিল বিশ্বমন্দা ও নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। আরও ছিল বন্যা, খাদ্যাভাব, সামাজিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সহায়-সম্বলহীন কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন – সবমিলিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো পুরো জাতির জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ ছিল। এমন অবস্থায় জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধস্ত দেশের হাল ধরেছিলেন। তার সেই সময়ের উদ্যোগগুলো ছিল বেশ প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী। প্রযুক্তিনির্ভর জাতির ভিত গড়তে তিনি স্বাধীনতার পর রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় স্থাপন করলেন ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। জোর দিলেন শিক্ষার ওপর।

১৯৭৩ সালে সারা দেশে প্রায় ৩৭,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুললেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম ইতিহাস এই যে; বঙ্গবন্ধু যখন এসব বিরুদ্ধ শক্তিকে প্রতিরোধ করে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনাসহ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে সপরিবারে নিহত হন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বাঙালির ইতিহাসে যুক্ত হয় এক কলঙ্কময় দিন। বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে যায়। তখন অনেকেই বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে স্বস্তির বিষয় এই যে; বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের গুণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আজ অনেকাংশেই বাস্তবায়িত।

সময়ের স্রোতে বাংলাদেশ এখন ৫০ বছরে পা দিতে চলেছে। আজ ২০২১ সালের ২৬শে মার্চ। পুরো দেশ উদযাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। নিঃসন্দেহে, পুরো দেশের জন্য এটি একটি গৌরবোজ্জল দিন। এখন প্রশ্ন হতে পারে; বিজয়ের ৫০ তম বছরে আমাদের অর্জন কতটুকু? কী কী অর্জন করতে পেরেছি আমরা? হয়তো আশানুরূপ অনেক কিছুই এখনো অর্জিত হয়নি; তবে যতটুকু অর্জিত হয়েছে – আনন্দ-উল্লাসের সাথে সেটুকু উদযাপন করতে তো দ্বিধা নেই।

এখন আর বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ’ কিংবা ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ’ হিসেবে পরিচিত নয়। বরং বাংলাদেশ এখন সবার কাছে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ‘নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

দেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৭ শতাংশ। এখন তা মাত্র ৬.২ শতাংশ। এ হার আরও কমানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি – উভয় সূচকের স্থিতিশীলতার বিচারেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান ছিল। আজ জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ শতাংশ, শিল্পের অবদান ৩০ শতাংশ এবং সেবা খাতের অবদান ৫৭ শতাংশ। দেশ আজ শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর। বর্তমানে দেশের কৃষি খাতেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে দেশের রপ্তানির সূচক বেড়েই চলেছে দিন দিন। বিদেশ থেকে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণও যথেষ্ট সন্তোষজনক। কর্মক্ষেত্রে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও বেড়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ২০১৫ সালের এমডিজি (মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) এর অধিকাংশ লক্ষ্য অর্জন করেছে।

দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে ‘মাদার অফ হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে ‘চ্যাম্পিয়ন অফ দ্যা আর্থ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বেশ উল্লেখযোগ্য।

পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়ালসেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোর কারণে দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার এখন উচ্চ পর্যায়ে। পৃথিবীতে যে ১১টি দেশকে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য ‘উদীয়মান এগারো’ বলে অভিহিত করা হয়; আমাদের বাংলাদেশ এখন তাদের মধ্যে অন্যতম।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে যেমন আমরা পেয়েছি অনেক অর্জন, তেমনি আমাদের রয়েছে অনেক ব্যর্থতা। গণতন্ত্রের শক্ত ভিত গড়ে উঠেনি। বরং বেড়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। একইসঙ্গে বেড়েছে আর্থিক বৈষম্য। পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। প্রশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা, রাজনীতিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিশাপ রয়েছে।

বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারীর কারণে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। দেশজুড়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সমস্যা। প্রতিনিয়ত করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আগামী দিনগুলোতে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। সেইসব চ্যালেঞ্জের জন্য আমাদের দৃঢ় মনোবল বজায় রাখতে হবে।

সুবর্ণ জয়ন্তীর হাত ধরে দেশে সুশাসন, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হোক। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়িত হোক। সফলতার দ্বার উন্মোচিত হোক।

মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা রইল সকলের প্রতি।বিনম্র শ্রদ্ধা রইল সেই সব বীর যোদ্ধাদের প্রতি, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

লিখেছেনঃ বৃন্তি সাহা

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।